অনলাইন ডেস্ক :
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বার কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক দি নিউ নেশন পত্রিকার প্রকাশক ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শনিবার (৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
আগামীকাল রবিবার সকাল সাড়ে ১০:৩০ টায় বারিধারা জামে মসজিদে তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
পরে বাদ জোহর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে আজিমপুর কবরস্থানে তার মা-বাবার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে।
মইনুল হোসেন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পিরোজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলের শিক্ষা তিনি লাভ করেন কলকাতা, পিরোজপুর ও ঢাকায়। ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হইতে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ছাত্রজীবনে স্কাউট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করিয়া ব্যারিস্টারী পড়িতে লন্ডন যান এবং মিডল টেম্পল-ইন এ ভর্তি হন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্যারিস্টার হিসাবে বার এ যোগ দেন এবং একই বছর ডিসেম্বরে ঢাকা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
লন্ডন অবস্থানকালে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের লন্ডনস্থ প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ঐ সময় তিনি কমনওয়েলথ প্রেস ইনস্টিটিউটেরও একজন সদস্য ছিলেন। ইউরোপীয় কমন মার্কেট কমিশনের আমন্ত্রণে তিনি ব্রাসেলস পরিদর্শন করেন।
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর ইত্তেফাক সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব তাহাকে পালন করিতে হয়।
১৯৬৯ এবং ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে চীনের জাতীয় দিবস উপলক্ষে সরকার প্রেরিত প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসাবে তিনি চীন সফর করেন।
পিতার মৃত্যুর কারণে সৃষ্ট ইত্তেফাকের প্রাথমিক ধকল কাটাইয়া উঠিবার পর আইন ব্যবসায় বেশি মনোযোগী হইবার অভিপ্রায়ে তিনি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক পদে না থাকিয়া সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি হন।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে পিরোজপুর (বরিশাল) জেলার পিতৃপুরুষের আবাসভূমি ভান্ডারিয়া-কাঠালিয়া নিয়া গঠিত নির্বাচনী এলাকা হইতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সংসদে তিনি নিবর্তনমূলক যে কোন আইন পাসের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী রাষ্ট্রপতির ৫০ নম্বর আদেশ জারির সময় তিনি খোলাখুলিভাবে ইহার বিরোধিতা করেন। পরবর্তীকালে সরকার আদেশটি রদ করে।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে সরকার যখন সংবিধানের মৌলিক চরিত্র পরিবর্তন করিয়া একদলীয় সরকার (বাকশাল) পদ্ধতির শাসন প্রবর্তন করে তখন তিনি তার প্রতিবাদে সংসদ সদস্য পদ হইতে ইস্তফা দেন।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ১৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর তিনি দেশে গণতন্ত্র ও বেসামরিক সাংবিধানিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ নেন। গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে একটি ব্যাপকভিত্তিক ঐক্যমঞ্চে সামিল করিতে তিনি তৎপর হন। দেশে একটি ভারসাম্যমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়িয়া তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করেন এবং এই লক্ষ্য অর্জনে তিনি ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগ নেন। এই প্রক্রিয়াকে ফলপ্রসূ করিবার কাজে তিনি যখন ব্যস্ত ছিলেন তখন সরকার তাহাকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে গ্রেফতার করিয়া এবং তিন মাস ডিটেনশনে আটক রাখিবার পর ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তি দেয়।
রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে উদার ও স্বাধীন মতামত রাখিবার জন্য তিনি নিউ নেশন নামে একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন — যাহা পরবর্তীকালে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি ও প্রেস কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশে প্রথম গঠিত প্রেস কমিশনেও তাহাকে সদস্য রাখা হয় এবং প্রেস কমিশনের রিপোর্ট প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন (২০০০-২০০১) এবং আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষায় মূল্যবান অবদান রাখেন।
অন্য যে কোন পরিচয়ের চাইতে নিজেকে তিনি আইনজীবী হিসাবেই দেখিতে পছন্দ করেন। স্বাধীন ও শক্তিশালী সংবাদপত্র ব্যতীত কোন ন্যায়ভিত্তিক, নিরাপদ সমাজ গড়িয়া উঠিতে পারে না — এই প্রত্যয় নিয়াই তিনি সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত রহিয়াছেন।
১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের বহুল আলোচিত ‘৩১ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি’র তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা এবং স্বাক্ষরদাতা। এই বিবৃতিতে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে নির্দলীয় জাতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানো হইয়াছিল। দেশ ও জাতির সমূহ বিপদকালে বিবেকবানদের নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকা উচিত নয়, এই উপলব্ধি হইতেই তিনি অন্যদের সঙ্গে একত্রে এই উদ্যোগ নিয়াছিলেন।
ওয়ান-ইলেভেনের পর তিনি এক বৎসর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা হিসাবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রক্ষায় এবং সরকারের নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়াছে। ‘বাংলাদেশ: বাস্তবতা ও প্রত্যাশা’, ‘গণতন্ত্রের সাফল্য চাহিয়াছি’, SUBSERVIENCE IS NOT FREEDOM’, ‘ঘুরে দাঁড়াতে হবে’, ‘আমার জীবন আমাদের স্বাধীনতা’, ‘বাংলাদেশ ঃ কি চেয়েছি কি পেয়েছি’, ‘HUMANITY OF JUSTICE’, স্বাধীন হয়েও স্বাধীন নই’, ‘BANGLADESH: Tragedy of Deceit and Duplicity’ তাহার উল্লেখযোগ্য রচনা।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তীব্রতর হচ্ছে ইসরায়েলি হামলায় লেবাননে যুদ্ধ