দেশের একমাত্র পাথর খনির কার্যক্রম বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে। খনি থেকে পাথর উত্তলন কার্যক্রম বন্ধ হলে বিপাকে পড়বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা, মাতারবাড়ী, শহাজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো। কারণ পাথর খনি থেকেই ওই প্রকল্পগুলোতে পাথর জোগান দেয়া হয়। তাছাড়া খনি বন্ধ হলে ৭শ’রও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে একই কারণে বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি বন্ধ হয়ে গেছে। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে মধ্যপাড়া পাথর খনির ঠিকাদার নিয়োগের কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। বর্তমানে বেলারুশের কোম্পানি জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) ওই খনি থেকে পাথর উত্তোলন করছে। আগামী ২ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী চুক্তি শেষ হওয়ার কমপক্ষে ৬ মাস আগে পরবর্তী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা। কিন্তু পাথর খনি প্রকল্পটির চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে, নাকি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
সূত্র জানায়, দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট দেশের একমাত্র পাথর খনিটি নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এর সাথে জড়িত রয়েছে পেট্রোবাংলা ও এমজিএমসিএলের একটি চক্র। ওই চক্রটি বড় অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে খনিটি তৃতীয় কারও কাছে তুলে দিতে চাচ্ছে। ওই কারণে টানা তিন মেয়াদে লাভজনক খনি থেকে পাথর উত্তোলনের ঠিকাদার নিয়োগ দিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। চক্রটি সময়ক্ষেপণ করে বড় ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে চাচ্ছে। তাতে বর্তমান কোম্পানিটি মেয়াদ শেষে চলে যাবে। তারপর খনি বাঁচানো কিংবা আইনের দোহায় দিয়ে তড়িঘড়ি অন্য কোনো কোম্পানির হাতে খনি তুলে দেয়া সম্ভব হবে। অথচ টানা তিন মেয়াদে বেলারুশ কোম্পানিটি প্রায় ৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। যে কারণে জিটিসির মেয়াদকাল আরো এক দফা বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ওই বিষয়ে অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও সিন্ডিকেট রহস্যজনক কারণে নয়ছয় করছে।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) ১৯৭৩-১৯৭৫ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া এলাকায় ১২৮ মিটার গভীরতায় কঠিন শিলা আবিষ্কার করে। আর উত্তর কোরিয়ার মেসার্স কোরিয়া সাউথ কোঅপারেশন করপোরেশনের সঙ্গে পাথর খনি উন্নয়নে ১৯৯৪ সালে মূল চুক্তি হয়। কয়েক দফা ব্যয় বৃদ্ধির পর ২০০৭ সালে পাথর খনির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পাথর উত্তোলন কাজ শুরু হয়। কিন্তু তাতে লোকসান হচ্ছিল। একপর্যায়ে খনিটি ৫শ কোটি টাকার বেশি লোকসানের বোঝা নিয়ে বন্ধের উপক্রম হয়। পরবর্তীতে খনিটিকে সচল রাখতে জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) এবং মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) মধ্যে চুক্তি হয়। ২০১৩ সালে ৬ বছর মেয়াদি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। আর ২০১৪ সালে পাথর উৎপাদন শুরু হয়। নানা বাধা পেরিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাথর খনিটি প্রথম লাভের মুখ দেখে। ওই অর্থবছরে প্রায় ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা লাভ হয়। তারপর থেকে মুনাফা অব্যাহত আছে। এমন অবস্থায় ঠিকাদারের মেয়াদ নবায়ন, নাকি দায়িত্ব নতুন কাউকে দেয়া হবে তা নিয়ে সময়ক্ষেপণ চলছে।
এদিকে খনি সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত না হলে খনিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বেআইনিভাবে বিদেশিরা এখানে কাজ করবে না। বর্তমানে শতাধিক বিদেশি খনি বিশেষজ্ঞ ও অর্ধশত দেশী প্রকৌশলী এবং ৭৫০ শ্রমিক সেখানে কাজ করছে। ইতিমধ্যে বৈশ্বিক মহামারি করোনার ভয়াবহতার কারণে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খনি বন্ধ করে চলে গেছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান জানান, মধ্যপাড়া পাথর খনির চুক্তি নিয়ে কাজ চলমান। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সেটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে। কাজ যাতে বন্ধ না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখেই কাজ করা হচ্ছে। ওই খনির ঠিকাদার নিয়োগে ৭ দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে বিদেশিদের সাড়া মেলেনি। এমন অবস্থায় চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আর কয়লা খনি বন্ধ থাকলেও যা মজুত আছে তাতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য বর্তমান ঠিকাদার কোম্পানি চীনা প্রতিষ্ঠান সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়ামকে পুনরায় নিয়োগ দেয়া হবে। আশা করা যায় শিগগিরই সিএমসি কাজ শুরু করতে পারবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি