November 18, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, September 25th, 2023, 8:35 pm

ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে একা হয়ে পড়ছেন ট্রুডো?

অনলাইন ডেস্ক :

সম্প্রতি কানাডায় শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকান্ডের ঘটনায় ভারত এবং কানাডার কূটনৈতিক অবস্থান তলানিতে পৌঁছেছে। কানাডা বলছে, এই হত্যাকান্ডের পেছনে যে ভারত সরকারের হাত রয়েছে সে বিষয়ে তাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে। অপরদিকে ভারত বিষয়টিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এর মধ্যেই দুদেশ পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক বহিষ্কার করায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কানাডা চাচ্ছে তাদের মিত্র দেশগুলো ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে। কিন্তু মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চলতি সপ্তাহে নিউইয়র্কে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো যখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন তখন তার মুখের হাসি যেন ক্রমেই মলিন হয়ে যাচ্ছিল।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নের প্রায় সবই ছিল ভারতের বিরুদ্ধে তোলা ট্রুডোর অভিযোগের বিষয়কে কেন্দ্র করে। গত সপ্তাহে ট্রুডো অভিযোগ করেন, কানাডার মাটিতে দেশটির একজন নাগরিকের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে ভারত সরকারের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেয়েছে কানাডা। নিহত ব্যক্তি হরদীপ সিং নিজ্জার একজন শিখ অধিকার রক্ষাকর্মী যাকে এর আগে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করেছিল ভারত। যদিও তার এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে ভারত।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সতর্কভাবে ট্রুডো বলেন, আমরা কাউকে উস্কানি দিতে চাই না বা কোনো সমস্যা তৈরি করতে চাই না। আমরা আইনের শাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। সে সময় কয়েকজন সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন যে, কানাডার মিত্ররা কোথায়? ট্রুডোকে উদ্দেশ্য করে এক সাংবাদিক মন্তব্য করেন, ‘প্রয়োজনের সময়’ আপনাকে একা মনে হচ্ছে।

সাদা চোখে অন্তত এখনো পর্যন্ত এটাই মনে হচ্ছে যে, ভারতের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার সময় ট্রুডোকে পুরোপুরি একাই দাঁড়াতে হয়েছে। ভারত বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। জনসংখ্যার দিক থেকে দেশটি কানাডার তুলনায় ৩৫গুণ বড়। ট্রুডো যেদিন কানাডার হাউজ অব কমন্সে ওই বিস্ফোরক ঘোষণা দেন, সেদিন থেকেই দেশটির প্রধান মিত্রদের কাউকেই শক্ত গলায় সহায়তার আশ্বাস নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।

যুক্তরাষ্টসহ বেশ কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা চক্রের (ফাইভ আইস ইন্টেলিজেন্স অ্যালায়েন্স) সাহায্যেই খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের খুনের তদন্ত চালাচ্ছে কানাডা। প্রধান মিত্রগুলোর সঙ্গে এই সংস্থার মাধ্যমে দেশটি নিয়মিত গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করে। কানাডা ছাড়াও এর অন্য সদস্যরা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। কী এই ফাইভ আইস? ইন্টারন্যাশনাল ইনটেলিজেন্সের এই গোষ্ঠীর সদস্য পাঁচ দেশ। কানাডা ছাড়াও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড।

গোটা বিশ্বে ঘটে চলা নানা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও চরবৃত্তির ওপর এই দেশগুলো একসঙ্গে নজর রাখে। পঞ্চ চক্র হিসেবেও পরিচিত এই গোষ্ঠী। কিন্তু ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে কানাডার পক্ষে এই দেশগুলো অনেকটা দায়সারা গোছের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে। কাউকেই ট্রুডোর পাশে শক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে দেখা যায়নি।

কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে মিত্ররা?
অস্ট্রেলিয়া বলছে, তারা এই হত্যাকান্ডের অভিযোগ নিয়ে ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’। অস্ট্রেলিয়ার মতোই অনেকটা একই ধরনের শব্দ বেছে নিয়েছে যুক্তরাজ্য। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লিভারলি বলেন, কানাডা যা বলছে তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখছে তার দেশ। সবচেয়ে নীরব প্রতিক্রিয়া এসেছে কানাডার প্রতিবেশী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। এই দুটি দেশ ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও যুক্তরাষ্ট্র কানাডার পক্ষ নিয়ে ভারতের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেনি। চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন ভারতের প্রসঙ্গ টানেন, তখন তিনি ভারতের প্রতি নিন্দা জানাননি। বরং নতুন অর্থনৈতিক পথ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার জন্য দেশটির প্রশংসা করেছেন।

বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কোন ‘প্রতিবন্ধকতা’ নেই। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে কানাডার সঙ্গে নিবিড়ভাবে আলাপ করা হচ্ছে। কিন্তু জনসমক্ষে প্রকাশিত অন্যান্য বিবৃতিতেও তেমন উত্তাপ ছিল না। দুই দেশের মধ্যকার চলমান বিরোধকে ‘গভীর উদ্বেগের’ বিষয় বলার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোতে ভারতের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের বিষয়টিও তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন ট্রুডোর জন্য সমস্যা হচ্ছে ভারতের ব্যাপক কৌশলগত গুরুত্বের তুলনায় কানাডার স্বার্থ কিছুটা মলিন হয়ে গেছে।

উইলসন সেন্টারের কানাডা ইন্সটিটিউটের গবেষক জেভিয়ার ডেলগ্যাডো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্য পশ্চিমা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক মিত্ররা চীনের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা ও পাল্টা পদক্ষেপের অংশ হিসেবে যে কৌশল ঠিক করেছে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভারত নির্ভর। সেটা এই মূহুর্তে চাইলেই তারা একেবারে বাদ দিতে পারবে না। মিত্ররা যে কানাডার প্রতিরক্ষায় দ্রুত এগিয়ে আসেনি, সেটা আসলে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় সকলের অবস্থানের ইঙ্গিত। কানাডার টেলিভিশন নেটওয়ার্ক সিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কানাডায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড কোহেন নিশ্চিত করে বলেছেন যে, ফাইভ আইস ভুক্ত দেশগুলো এ বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করেছে।

এই মিত্র দেশগুলোই জনসমক্ষে হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকান্ডের নিন্দা জানাতে কানাডার আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে উল্লেখ করে যে প্রতিবেদন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, গোপন কূটনৈতিক আলোচনার বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে চান না। তবে এ ঘটনা বিশ্বমঞ্চে কানাডার দুর্বল অবস্থানেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে। পশ্চিমাদের নির্ভরযোগ্য এই মিত্র দেশটি নিজ গুণে পরাশক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। কানাডা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ক্রিস্টোফার স্যান্ড মনে করেন, এখানে একটি শক্তির খেলা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করছে শক্তি, ক্ষমতা এবং আর্থিক বিষয়, যার ঠিক কোনটাই কানাডার নেই। ট্রুডোর অভিযোগ সত্য হলে এটি হবে কানাডার মাটিতে একটি রাজনৈতিক হত্যাকা- যা ঘটিয়েছে আরেকটি গণতান্ত্রিক দেশ। তবে এসব নৈতিক বিষয় বৈশ্বিক মনোযোগ ঘোরাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

ট্রুডোর জন্য এই শীতল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার মানে হচ্ছে, বেশ কিছু সময় ধরে একা হয়ে পড়া এবং এই সময়ের মধ্যে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকা। যার মধ্যে রয়েছে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক বহিষ্কার, ভ্রমণে সতর্কতা জারি, আর সবচেয়ে নাটকীয় হচ্ছে ভারত ভ্রমণে ইচ্ছুক কানাডার নাগরিকদের জন্য ভিসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত। দেশের ভেতরে এবং বাইরে ট্রুডো এখন সামান্য চাপে আছেন বলেই মনে হচ্ছে। কানাডার নাগরিকরা একদিকে মুদ্রাস্ফীতি এবং উচ্চ সুদহার নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। অপরদিকে দেশটির নির্বাচনে চীনের হস্তক্ষেপের অভিযোগ সামনে এসেছে। সমালোচকরা বলছেন, ট্রুডো এবং তার মন্ত্রীসভা বিষয়টি জানলেও এটি তারা গুরুত্ব সহকারে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যেই দেশটির কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার পল বার্নার্ডোকে একটি কম নিরাপত্তা বেষ্টিত কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে এমন খবর প্রকাশ হওয়ার পর দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ নিয়েও ট্রুডো এবং তার সরকার আরেকবার চাপের মুখে পড়েছে।

চলতি মাস পর্যন্ত ট্রুডোর প্রতি জনসমর্থন গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমে এসেছে। নির্দলীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাঙ্গাস রিড ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট শাচি কার্ল বলেন, গত ৮ বছরের মধ্যে তার জনসমর্থন এতোটা কমেনি। তাকে নানা ধরণের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে, যেমন- আপনি কি আরও ক্ষমতায় থাকতে চান? আপনি কি পদত্যাগ করবেন? এটা ট্রুডোর জন্য আরও একটি শীতল বাস্তবতা। তিনি একজন তারকার মতো ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। গ্লোব এ- মেইল পত্রিকার প্রধান রাজনৈতিক লেখক ক্যাম্পবেল ক্লার্ক বলেন, তিনি একজন সেলিব্রেটি যা আমরা কানাডার রাজনীতিতে কখনো দেখিনি। আর নির্বাচনে জয়লাভের পর তার জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে।

কিন্তু আট বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকার পর মনে হচ্ছে কানাডীয় নাগরিকদের সাধ মিটে গেছে। ক্লার্ক বলেন, মনে হচ্ছে ট্রুডোর তারকা শক্তি মলিন হয়ে এসেছে। বিশেষ করে, গত কয়েক মাসে অন্তত তেমনটাই মনে হচ্ছে। এখনো অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য সতর্ক করে বলেছেন যে, ভারতের সঙ্গে এই উত্তেজনায় মনে হতে পারে যে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ট্রুডো একা দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু দেশের মধ্যেও এই ধাক্কাটা দরকার ছিল। ক্লার্ক বলেন, এই উত্তেজনা তাকে সব ধরনের অভ্যন্তরীণ প্রশ্ন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ট্রুডো অবশ্য এই সপ্তাহ শেষ করেছেন আরেক মিত্র দেশ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। অন্তত এই সময়টায় তিনি বেশ ভালো সঙ্গ পেয়েছেন বলা যায়।