নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনা ভাইরাসের বিষদাঁত এখনো উৎপাটিত হয়নি। বিশ্ব এখনো সংক্রমিত। বাংলাদেশে চলতি বছরের মাঝামাঝিতে করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল। সে সময় প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড হয়েছে। তবে গত দুই মাস পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। কমেছে কভিড-১৯ রোগের প্রকোপ। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতে আবারো ভাইরাসটির সংক্রমণ ও এতে মৃত্যুর সংখ্যা আবারো বাড়তে শুরু করেছে। ফলে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ভারত থেকে যেন সংক্রমণ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকার। সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় এ বিষয়ে সাতটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে সরকারে বেশ কয়েকটি বিভাগের সচিব ও পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে সম্প্রতি উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে সীমান্ত এলাকায় নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার সংখ্যা ও কোয়ারেন্টিন সুবিধা বাড়ানোসহ সাত দফা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হলো বিমান ও স্থলবন্দরগুলোতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষার ব্যবস্থা, সবাইকে মাস্ক পরতে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করার কার্যক্রম জোরদার করা, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে বেশি পরিমাণ জায়গা নিয়ে করোনা শনাক্তকরণ ল্যাব স্থাপন, স্থানীয় সব পর্যায়ে গঠিত কমিটিকে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেয়া, জনপ্রশাসনের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সুষ্ঠুভাবে টিকাদান কার্যক্রম ও করোনা মোকাবেলায় সার্বিক সহযোগিতার জন্য নির্দেশনা দেয়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য নির্দেশনা দেয়া।
ভারতের সব মিশন থেকে হালনাগাদ তথ্য নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। জানা যায়, ভারতের কেরালায় সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। অঞ্চলটি বাংলাদেশ থেকে দূরে হলেও সার্বিক প্রস্তুতি হিসেবে সীমান্ত এলাকায় নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তে পরীক্ষার সংখ্যা ও কোয়ারেন্টিন সুবিধা বাড়ানো এবং ট্রাকচালকদের টিকা দেয়ার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
জানা যায়, বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যার সংখ্যা শতকরা ৯৫ শতাংশ ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় ৯৯ শতাংশ খালি রয়েছে। সরকারের হাতে আড়াই কোটি টিকা রয়েছে। এখনো দৈনিক ছয় লাখ টিকা দেয়া হচ্ছে, যা আগামীতে ১০ থেকে ১৫ লাখে উন্নীত করা হবে বলেও জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ রোধে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রায় ৬৭ হাজার প্রান্তিক প্রতিনিধি এ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ইউনিয়ন ট্যাগ অফিসারদের এ কমিটিতে সহায়তা ও পরামর্শ দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সারা দেশে স্থানীয় সরকারের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো সার্বক্ষণিক খোলা রেখে করোনা মোকাবেলায় কাজ করা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংযুক্ত আরব আমিরাতগামী কর্মীদের জন্য করোনা সংক্রমণ শনাক্তে ল্যাব স্থাপনসহ প্রবাসীদের চাহিদা অনুযায়ী টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিমানবন্দরটিতে আরো একটি পরীক্ষাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্য খাতে গত চার মাসে ১৪ হাজার চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
রোগতত্ত্ববিদদের মতে, করোনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কার্যকরী ব্যবস্থা হলো মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করা, রোগী ব্যবস্থাপনা ও টিকা কার্যক্রম জোরদার করা। এসব বিষয়ে আগেও ঘাটতি দেখা গেছে। সিদ্ধান্ত নিলেও তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয়নি। দেশে করোনার সংক্রমণ আবারো বাড়বে বলেও আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন তারা।
তাঁরা আরও বলেন, নভেল করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আমাদের অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্য এশিয়া, পূর্ব ইউরোপসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সংক্রমণ আবারো বেড়েছে। এখন দেশে যে সংখ্যক রোগী শনাক্ত হচ্ছে, তাতে তাদের পরিপূর্ণ ব্যবস্থায় আনা সম্ভব। তাদের চিকিৎসা নিশ্চিতের পাশাপাশি আলাদা করে রাখতে হবে। তাদের সংস্পর্শেও যারা আসবেন, সেসব ব্যক্তিকেও আলাদা রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। চিকিৎসা ও রোগ ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অবকাঠামোগত দুর্বলতা।
করোনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আমাদের ইচ্ছে বা আকাক্সক্ষা থাকলেও বাস্তবায়নের চিত্র ভিন্ন। যখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হলো তখন কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারিনি। কাগজে-কলমে অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সীমান্তও বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সীমান্ত বা বিমানবন্দর কোথাও সন্তোষজনক কিছু দেখা যায়নি। স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষকে এখন পর্যন্ত সচেতন করতে বা বাধ্য করা যায়নি।
তবে খুশির সংবাদ এই যে, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশে মলনুপিরাভির অ্যান্টিভাইরাল ট্যাবলেটের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। চার দিন আগে যুক্তরাজ্য সরকার এ ওষুধের অনুমোদন দেয়। সোমবার রাতে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন এবং সহকারী পরিচালক অজিউল্লাহ সাংবাদিকদেরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তাঁর ভাষ্য, দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মলনুপিরাভিরের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিল। অধিদপ্তর প্রাথমিকভাবে অনুমোদন দিয়েছে। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে মলনুপিরাভির উৎপাদন ও বিপণনের অনুমতি চেয়েছে। খুব শিগগির তাদের ‘রেসিপি’ অনুমোদন দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের দুই কোম্পানি মার্ক শার্প অ্যান্ড ডোম (এমএসডি) ও রিজেবাক বায়োথেরাপিউটিক যৌথভাবে তৈরি করেছে মলনুপিরাভির নামে মুখে খাওয়ার এই ওষুধ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম ঢেউয়ের সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে প্রতিটি জেলায় আইসিইউ ও অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা আজও সম্ভব হয়নি। এখন দেশের করোনা পরিস্থিতি ভালো, এমন অবস্থায় ভারতের সংক্রমণ বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে শুধু কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ নয়, তা যেন বাস্তবায়ন করা যায় সেই প্রস্তুতি নিতে হবে। টিকাদান কর্মসূচিতেও দক্ষিণ এশিয়ায় সবার চেয়ে পিছিয়ে আছি আমরা। মহামারির দুটি ঢেউ চলে গেলেও আমরা জনসংখ্যার মাত্র এক-চতুর্থাংশের মতো মানুষকে টিকা দিতে পেরেছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে, আগে বয়স্ক লোকদের টিকা নিশ্চিত করতে বলা হলেও সেটি মানা হয়নি। সব বয়সীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ফলে নাগরিকদের নির্দিষ্ট কোনো অংশের সুরক্ষা পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। সেটি করা গেলে করোনার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বয়স্কদের মৃত্যু হয়তো অনেকাংশে ঠেকানো যেত।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২