অনলাইন ডেস্ক :
ভারত ও পাকিস্তানের কিছু অংশে বয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক তাপদাহ থার্মোমিটারের পারদকে নিয়ে গেছে রেকর্ড উচ্চতায়; তীব্র গরম ঝুঁকিতে পড়েছে দুই দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এক সংকট এখন অনুভূত হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের সবখানেই। ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের (আইএমডি) বরাতে সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এপ্রিলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৩৫ দশমিক ৯ এবং ৩৭ দশমিক ৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা রেকর্ড রাখা শুরুর পর ১২২ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত মাসে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে পরপর সাত দিন তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে, যা এপ্রিলের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। অনেক রাজ্যে গরমের কারণে স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে, ফসলের ক্ষতি হয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহে চাপ পড়েছে। অবস্থা এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল যে কর্তপক্ষ সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। ওই তাপপ্রবাহ প্রতিবেশী পাকিস্তানকেও ভুগিয়েছে। পাকিস্তানের আবহাওয়া দপ্তরের (পিএমডি) তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণাঞ্চলীয় সিন্ধু প্রদেশের জাকোবাবাদ ও সিবি শহরে গত শুক্রবার ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। পিএমডির তথ্য বলছে, ওই দিন উত্তর গোলার্ধের যে কোনো শহরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সেটা। দেশটির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী শেরি রেহমান এক বিবৃতিতে বলেন, কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মত পাকিস্তানকে এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, যাকে বলা যায় ‘বসন্তহীন বছর’। তার ভাষায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এই সঙ্কট যেন তার দেশের মানুষকে ‘টিকে থাকার সংগ্রামের’ মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের পত্রিকা গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আপেল ও পিচ বাগানের জন্য বিখ্যাত পাকিস্তানের বালুচিস্তানে ফলন কমে গেছে। আপেল গাছে এবার ফুল এসেছে স্বাভাবিক সময়ের এক মাস আগে। এরপর প্রচ- তাপে সব ফুল ঝরে গেছে। তাতে মাথায় হাত পড়েছে খামার মালিকদের। শেরি রহমান বলছেন, পানির উৎসও শুকিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বাঁধগুলোতে পানির মজুদ এখন একদম শেষ সীমায় রয়েছে। এ সপ্তাহে ভারতে তাপমাত্রা কিছুটা কমতে পারে, বিশেষ করে উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে তা ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমডি। এ সপ্তাহের শেষভাগে পাকিস্তানেও গড় তাপমাত্রা কিছুটা কমে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে অবস্থান করতে পারে বলে জানিয়েছে পিএমডি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট আরও নিয়মিত এবং দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহের কারণ ঘটাবে, যা এ দুই দেশের একশ কোটির বেশি মানুষের জীবনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় থাকতে পারে ভারত। ইনডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান সেটেলমেন্টসের জ্যেষ্ঠ গবেষক এবং আইপিসিসির প্রতিবেদনের প্রধান রচয়িতা ড. চাঁদনি সিং বলেন, “এটা নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ। এর তীব্রতা, আগমনের সময়, ও মেয়াদের ক্ষেত্রে আমরা একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এমন কিছুরই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব হবে মারাত্মক।”
ফসলহানি
গ্রীষ্মে মে ও জুন মাসে ভারতে প্রায়ই তাপপ্রবাহ বয়ে যায়, কিন্তু এ বছর মার্চ ও এপ্রিল থেকেই তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। ভারতের ‘রুটির ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চীয় পাঞ্জাব রাজ্যে এবার লাখ লাখ চাষি গরমের কারণে ভুগছেন; তাপদাহে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের গমের ক্ষেত। পাঞ্জাবের কৃষি বিভাগের পরিচালক গুরভিন্দর সিং সিএনএনকে জানান, এপ্রিলে গড় তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ায় গমের ফলন এবার কম হয়েছে। প্রতি হেক্টরে লোকসান হয়েছে প্রায় ৫০০ কেজি করে। আইপিসিসির চাঁদনি সিংও বলছেন, অতিরিক্ত গরমের কারণে কৃষি খাতের কর্মীরা আরও বেশি ভুগবেন। “যারা বাইরে কাজ করেন, যেমন কৃষক, নির্মাণ খাতের শ্রমিক, দিনমজুর, তাদের ভুগতে হবে সবচেয়ে বেশি। তাদের শরীর জুড়ানোর সুযোগ কম এবং গরম থেকে দূরে থাকাও সম্ভব নয়।”
স্কুল বন্ধ, বিদ্যুৎ বিভ্রাট
ভারতের কিছু অংশে, বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ায় কয়লার সংকট দেখা দিয়েছে, যার ফলে দিনে ৯ ঘণ্টাও বিদ্যুৎহীন থাকতে হয়েছে লাখ লাখ বাসিন্দাকে। দিল্লির বিদ্যুৎ দপ্তরে হিসাবে, গত সপ্তাহে পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটিতেই কয়লার মজুদ সংকটজনক পর্যায়ে নেমে যায়। সেদেশের রেল মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে কয়লার সরবরাহ ঠিক রাখতে পুরো মে মাসে মালবাহী ট্রেনের চলাচল নির্বিঘœ করার জন্য ভারতে ৬৫০টির বেশি যাত্রীবাহী ট্রেনের সূচি বাতিল করা হয়েছে। তাপমাত্রা বেড়ে চলায় পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার মতো কয়েকটি রাজ্যে স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেন, অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ছে, অনেকের নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে, প্রচ- তাপ তারা সহ্য করতে পারছে না। চাঁদনি সিংয়ের মতে, ভবিষ্যতের তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে শুধু স্কুল বন্ধ লাখলেই হবে না, আরও বেশি কিছু প্রয়োজন হবে। “আমাদের তাপপ্রবাহ মোকাবেলার কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। যে পরিকল্পনা আমাদের আছে, তাতেও অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। আপনি আসলে কতটা খাপ খাওয়াতে পারবেন? এই তাপপ্রবাহগুলো যেন মানুষের টিকে থাকার ক্ষমতার পরীক্ষা নিচ্ছে।”
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২