নিজস্ব প্রতিবেদক:
যে কোন দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূলে রয়েছে বিদ্যুৎ। শিল্পোন্নত দেশ হওয়ার প্রধান মানদন্ডই হলো বিদ্যুতের বহুল প্রাপ্যতা। কেননা শিল্প-কলকারখানা সচল রাখার জন্য বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ থাকা অপরিহার্য।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ খাতে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। দুর্গম পাহাড় থেকে চরাঞ্চল, খাল-বিল-মাঠ পেরিয়ে এরই মধ্যেই গ্রিড এলাকার শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে। অফগ্রিড যেসব এলাকা রয়েছে, সেখানকার মানুষের কাছে বিদ্যুতের আলো পৌঁছানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা যায়। শিগগিরই ভোলা ও পটুয়াখালীর দুর্গম চরের কয়েক লাখ মানুষ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হতে যাচ্ছে বলে জানা যায়।
জানা যায়, বিদ্যুৎ খাতে সাফল্যের বেশির ভাগ এসেছে ২০০৯-২০ সালে অর্থাৎ মাত্র ১১ বছরে। স্বাধীনতার ৩৯ বছরে (১৯৭১-২০০৯) যেখানে ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় ছিল, সেখানে ২০২১ সালের মধ্যে অর্থাৎ মাত্র ১২ (২০০৯-২১) বছরে অবশিষ্ট ৫৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। এর মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক অঙ্গীকারও বাস্তবায়ন হচ্ছে। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের সব মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনার কথা উল্লেখ করা হযেছে।
বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশের অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন হলেও গ্যাস খাতে বেশ সংকট চলছে। সংকট মোকাবেলায় সরকার তরল গ্যাস আমদানি শুরু করে। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংসদে তথ্য দিয়েছেন, উত্তোলনযোগ্য নিট মজুদের পরিমাণ ১২ দশমিক ৫৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এটি বছর দুয়েক আগের তথ্য। ব্যবহারের কারণে বর্তমানে গ্যাসের মজুদ আরো কমেছে। বাংলাদেশে এখন গ্যাসের মজুদ ১২ টিসিএফ আছে। প্রতি বছর এক টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে মজুদকৃত গ্যাস দিয়ে আগামী ১২ বছর চলার কথা। কিন্তু অনেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে সেটি দিয়ে ১০ বছরের বেশি চলবে না। ফলে এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে সেটি চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। বর্তমানে এলপিজি গ্যাসের দাম চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উর্ধ্বমুখী দামের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে গত এক দশকে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের যেমন পারস্পরিক সহযোগিতা বেড়েছে তেমন গ্যাসের ক্ষেত্রেও সম্পর্ক বৃদ্ধির পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। দেখা যায়, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে গত এক দশকে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশেষকরে নানা আঙ্গিকে সহযোগিতা বেড়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, কয়লা সরবরাহের পাশাপাশি বাংলাদেশে সরাসরি বিদ্যুৎ রফতানিও করছে দেশটি। জানা যায়, শিগগিরই শুরু হতে যাচ্ছে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ¦ালানি তেল আমদানিও। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারত-বাংলাদেশের এ সহযোগিতার সম্পর্কটিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এতে রয়েছে ভূরাজনৈতিক কারণও।
বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে সহযোগিতা পেয়ে আসছে। জানা যায়, বাংলাদেশে এখন ভারতীয় সহযোগিতায় নির্মিতব্য চার হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। দু-তিন বছরের মধ্যে এসব প্রকল্প উৎপাদনে আসবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাতে গুরুত্ব বাড়িয়েছে ভারত। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে জ¦ালানি সরবরাহে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল রফতানির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ লাইনের মাধ্যমে বছরে অন্তত ১০ লাখ টন জ¦ালানি তেল রফতানির পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ¦ালানি সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠেছে ভারত।
ভূরাজনৈতিক কারণে চীনও বাংলাদেশকে হাতে রাখতে চায়। ফলে চীনও বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য উদগ্রীব। বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে উত্থানের পর থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়িয়ে চলেছে চীন। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দেশটি বিনিয়োগ করেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঋণ প্রতিশ্রুতি। এদিকে গত এক দশকে তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বাংলাদেশকে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারতের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয় যেমন রয়েছে, তেমনি এতে ভূরাজনীতিও ভূমিকা রাখছে। তবে বাণিজ্যের বিষয়টিকে এগিয়ে রাখতে হবে। কারণ খাতটি এখন সবচেয়ে বেশি টেকসই ও স্থায়ী। বিনিয়োগে সব দেশেরই কমবেশি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে চীনের বিনিয়োগও ভারতকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করতে পারে। কৌশলগত দিক থেকে ভারতের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে নানা ধরনের সহযোগিতা ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে বাংলাদেশের আগ্রহে থাকতে চায় দেশটি।
জ্বালানি খাতে ভারতের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রায় এক যুগ হয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালে দেশটির সাথে বাংলাদেশের একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়ন, জ¦ালানি দক্ষতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, গ্রিড কানেক্টিভিটি নিয়ে দুই দেশের যৌথ একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। জানা যায়, সমঝোতা চুক্তির আওতায় শুরুতে ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এরপর পর্যায়ক্রমে এটি বাড়তে থাকে। বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর ও বাংলাদেশের ভেড়ামারা দিয়ে এক হাজার মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা-কুমিল্লা দিয়ে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। গত বছর ত্রিপুরা-কুমিল্লা দিয়ে আরো ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করে যা ২০২৬ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
তবে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকার ভারতের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে চায়। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মানের পাশাপাশি বহুমুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। আগামী ১৫ বছরে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে অন্তত এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে তা শিল্পায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শিল্পায়নের বড় উপকরণ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ