নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর সাধারণ যাত্রীদের পরিবহণ দুর্ভোগ লাঘব হচ্ছে না কোনভাবেই। ওয়েবিল অনুযায়ী যাত্রীরা ভাড়া দিতে না চাওয়ার জেরে মঙ্গলবার দুপুরে হঠাৎ করে মিরপুর সড়কের গাড়ি বন্ধ করে দেন পরিবহণ শ্রমিকরা।
সূত্র জানায়, মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় মিরপুর ১২ নম্বর চন্দ্রবিন্দু মোড়ে কয়েকশ শ্রমিক জড়ো হয়ে বাস থামিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দেন। এতে দুর্ভোগে পড়েন শত শত যাত্রী। শ্রমিকদের এ আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে পড়লে মিরপুরের কালশী, পূরবী, মিরপুর ১১ নম্বর, ১০ নম্বর এলাকায় পরিবহণ শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করেন। তারাও বাস থামিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দেন। আন্দোলনকারী শ্রমিকরা জানান, নতুন ভাড়া নির্ধারণের পর যাত্রীদের কাছ থেকে সে পরিমাণ ভাড়া তারা আদায় করতে পারছেন না। অনেক সময় বাকবিত-া হয়। যাত্রীদের কাছে ভাড়া চাইতে গেলে তারা দুর্ব্যবহার করে। অনেক সময় যাত্রীরা তাদের মারধর করে। বাস মালিকরাও ভাড়া কম নিতে চান না। শ্রমিকদের পকেট থেকে হলেও বাস মালিকদের ভাড়া সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে হয়।
সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের জন্য মালিক ও যাত্রীদের দোষারোপ করছেন পরিবহণ শ্রমিকেরা। তাদের দাবি, সরকার থেকে নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা থাকলেও মালিকপক্ষের চাপে ওয়েবিল অনুযায়ী ভাড়া নিতে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের। আর ওই ভাড়া দিতে কোনো রাজি নন যাত্রীরা।
বাস মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করে ৬ হাজারের বেশি বাস। এর মধ্যে অনেক বাসে ওয়েবিল সিস্টেম ও সিটিং সার্ভিসের নামে উচ্চহারে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি বাস তল্লাশি করে জরিমানা করছে। কিন্তু জরিমানা দেয়ার পরই ওই বাসগুলো আবার যাত্রীদের জিম্মি করে বেশি ভাড়া আদায় করছে। পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত দেখলেই যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া ফেরত দিয়ে যাত্রীদের অনুরোধ করছে কিছু না বলার জন্য। বিআরটিএ পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত আর বাস চালকদের মধ্যে এই ইঁদুর-বিড়াল খেলার মাঝখানে যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে।
সরকার ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করলেও সিএনজি গ্যাসের দাম বাড়ায়নি। এ অবস্থায় ঘোষণা দেয়া হয় ডিজেলচালিত বাসগুলোতে ভাড়া বাড়বে তবে সিএনজিচালিত বাসে আগের ভাড়া নিতে হবে। এজন্য যাত্রীরা যাতে বুঝতে পারেন কোনটি ডিজেল আর কোনটি সিএনজিচালিত বাসে ‘স্টিকার’ লাগিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু প্রায় সবগুলো বাসেই ডিজেলচালিত স্টিকার লাগিয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করে বাসগুলোর শতকরা ৯৫ ভাগ সিএনজিচালিত। যাত্রী কল্যাণ সমিতি একাধিক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, ঢাকায় চলাচলকারী শতকরা ৯৫ ভাগ বাস সিএনজিচালিত। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দাবি উল্টো। তাদের দাবি মোট বাসের মাত্র ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ সিএনজিচালিত। সংগঠনটি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে ঢাকা মহানগরী, শহরতলি ও পাশের ৩ জেলায় (গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ) চলাচল করছে ১২০ কোম্পানির ৬ হাজার বাস। এর মধ্যে ১৩টি কোম্পানির মাত্র ১৯৬টি গাড়ি সিএনজিতে চলাচল করছে। এটা মোট বাসের ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। বাস মালিক সমিতি জানায়, ঢাকা মহানগরীতে চলা গ্রেট তুরাগ ট্রান্সপোর্টের ৪০টি, অনাবিল সুপার লিমিটেডের ৫টি, প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন লিমিটেডের ১২টি, শ্রাবণ ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ৩০টি, আসিয়ান ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ২০টি, মেঘালয় ট্রান্সপোর্টের ৫টি, হিমালয় ট্রান্সপোর্টের ১৪টি, ভিআইপি অটোমোবাইলের ২টি, মেঘলা ট্রান্সপোর্টের ২৭টি, শিকড় পরিবহনের ৮টি, বিকল্প অটো সার্ভিসের ১টি, গাবতলী লিংক মিনিবাস সার্ভিসের ১১টি, ৬ নং মতিঝিল-বনানী কোচ লিমিটেডের ২১টি বাস সিএনজিতে চলাচল করছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ জানান, রাজধানীতে ওয়েবিল সিস্টেম এবং সিটিং সার্ভিস ভাড়া আদায় বন্ধ করা হয়েছে। আর স্টিকার দেখে যাত্রীরা সিএনজি ও ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া দেবেন। কিন্তু রাজধানীতে চলাচলকারী প্রায় সব বাসেই ‘ডিজেলচালিত’ স্টিকার লাগানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিআরটিএ ১৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানোর ঘোষণা দিলেও তিন-চার দিন ৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়েছিল। মঙ্গলবার কোনো আদালত বসানো হয়নি। তবে মালিক সমিতির লোকজনও নিজেরা পথে পথে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা ঠেকাতে অভিযান পরিচালনা করে। এসবই হচ্ছে টিভির ক্যামেরানির্ভর। কিছু গণমাধ্যম কর্মীকে কিছু টাকা দিয়ে ডেকে নিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে মালিক সমিতির তৎপরতার সচিত্র খবর মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে।
এদিকে, বাড়তি ভাড়া আদায় নেওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১০৪টি বাসের চালককে ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০১টি বাস ডিজেলচালিত। বাকি তিনটি সিএনজিচালিত। মঙ্গলবার বিআরটিএ-এর ১০টি মোবাইল কোর্ট এ জরিমানা করে। এ সময় বাড়তি ভাড়া নেওয়ার ঘটনা পুনরাবৃত্তি হওয়ায় একটি বাস ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়। অভিযানে এই ১০৪টিসহ মোট ৩৪২টি বাসের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এদিকে মঙ্গলবার বাসের বাড়তি ভাড়াবিরোধী অভিযান পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম, বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মাদ মজুমদার এবং পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. সরওয়ার আলমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, সরকার ২০০৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন করলেও গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে যাত্রীদের স্বার্থ উপেক্ষিত। বাসের ভাড়া বৃদ্ধির সাথে সাথে লেগুনা, হিউম্যান হলার, নছিমন-করিমন, অটো-টেম্পো, অটোরিকশাসহ সব ধরনের যানবাহনের ভাড়া বেড়েছে। এসব পরিবহনের ৯৮ শতাংশ সিএনজিচালিত হলেও ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে অন্যায়ভাবে যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে। অথচ এসব নিয়ে মামলা হওয়ার হার খুবই কম। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, লালবাগ ট্রাফিক পুলিশ অক্টোবর মাসে দুই হাজার ৪০৬টি মামলা করেছে। কিন্তু বেশি ভাড়া আদায় করার কারণে মামলা হয়নি। এক হাজার ২৬২টি মামলা হয় চলন্ত বাসে যাত্রী উঠানো-নামানো কিংবা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য। এ ছাড়াও লাইসেন্স না থাকা, রেজিস্ট্রেশন ছাড়া গাড়ি চালানো, গাড়ির ফিটনেস না থাকা, ক্রটিপূর্ণ গাড়ি চালানো, পরিবেশ দূষণকারী কালো ধোঁয়ার কারণে মামলা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে (গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) বিআরটি এর ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই হাজার ৬৪৬টি অভিযান পরিচালনা করেন। এসব অভিযানে ১৯ হাজার ১৮টি মামলা হয়। দুই কোটি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে কতগুলো মামলা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম