জেলা প্রতিনিধি, সিলেট :
ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে গত পৌনে চার বছরে ৪৭ বার কেঁপেছে বাংলাদেশ। এসব ভূমিকম্পের উৎসস্থলের ২০টি ছিল দেশের ভেতর, যার ১১টিই সিলেটে।
পাশেই ডাউকী ফল্ট থাকায় ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনপদ সিলেট বার বারই কেঁপে উঠছে। চলতি বছরের ২৯ই মে শনিবার মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ৬ বার কেঁপে উঠে শাহজালালের এই পূন্যভূমি। পরে ৭ জুন মিনিটের ব্যবধানে কাঁপুনি উঠে সিলেটের বুকে। তখন এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলও ছিল সিলেটে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ডাউকী ফল্টে ওলটপালট হলে ভয়াবহ কিছু হতে পারে সিলেটে। স্থানীয়ভাবে উৎপত্তি হয়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেট নগরে নেমে আসতে পারে দুর্যোগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বড় রকমের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। বারবার ভূমিকম্প হওয়ার অর্থ ফল্ট লাইনগুলো সক্রিয় আছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৭টি ভূমিকম্পের প্রভাবে কেঁপেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ৪ বার, ২০১৯ সালে ৭ বার, ২০২০ সালে ১৫ বার এবং চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ২১ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সর্বশেষ ৭ অক্টোবর রাত ১২টা ২৮ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল মিয়ানমারের মানওয়া। ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১৪ কিলোমিটার গভীরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেটে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এ অঞ্চলের প্রায় ৮০ ভাগ স্থাপনা ধসে পড়তে পারে। এতে প্রাণ হারাবে প্রায় ১২ লাখ মানুষ এবং ক্ষতি হবে ১৭ হাজার কোটি টাকার। কারণ, সিলেটে কোনো নিয়ম নীতির না মেনেই গড়ে উঠছে একের পর এক বহুতল ভবন। মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড। জলাশয় ভরাট- টিলা কাটা চলছে অহরহ। ফলে এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বেড়েই চলছে। একটু বড় ধরনের ভূমিকম্প হলেই তাসের ঘরের মতো ধসে পড়বে সিলেটের সব অট্টালিকা। প্রাণ হারাবেন কয়েক হাজার মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে সিলেট নগরী। এমনি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট বিভাগ।
ঢাকা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সিনিয়ার আবহাওয়াবিদ মুমিনুল ইসলাম বলেন, সিলেট অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে। বিশেষ করে তিনটি পেল্গটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশ। ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে সিলেট হয়ে ভুটান পর্যন্ত ভূগর্ভে যে চ্যুতি আছে, তাতে বিপুল পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সিলেট থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দুরে এ চ্যুতি। ফল্টলাইনগুলোকে ভূকম্পন হয়। ভূমিকম্পের প্রিশক ও আফটারশক থাকে। অনেক সময় বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট কম্পন হয়। আবার বড় ভূমিকম্প হলে তারপর ছোট ছোট কম্পন হয়। যেহেতু সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারি বলেন, ‘গত দু-তিন বছরে দেশে ভূমিকম্পের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আবার ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের এখানে বড় ভূমিকম্প হয়নি তেমন। এটা একটা জিনিস নির্দেশ করে যে এগুলো শক্তি সঞ্চয় করছে। ফলে সামনে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা আছে।’
ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম ১৯৯৮-এর জরিপ অনুযায়ী ‘সিলেট অঞ্চল’ সক্রিয় ভূকম্পন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
১৮৩৩, ১৮৮৫, ১৮৯৭, ১৯০৫, ১৯৩০, ১৯৩৪, ১৯৪৭ ও ১৯৫০ সালের বড় ভূকম্পনের মধ্যে দুটিরই উৎপত্তিস্থল ছিল (এপি সেন্টার) সিলেটের জৈন্তার ভূগর্ভে। একই উৎপত্তিস্থল থেকে ঘটে যাওয়া ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সিলেট অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেটি ভূকম্পনের ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট আসাম আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ মাত্রার বেশি।
এই ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনসহ সিলেট ও আসাম অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটে।
১৯৫০ সালে অসমে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণে সিলেট অঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ছিল। এই ভূমিকম্পটি ‘আসাম-তিব্বত আর্থকোয়েক’ নামে ইতিহাসে পরিচিত রয়েছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮.৬।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (পিডিএমপি) প্রকল্পের সাবেক পরিচালক আবদুল কাইয়ূম বলেন, ফল্ট লাইন সক্রিয় থাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগ থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন তাঁরা। যেমন ভূমিকম্প–সহনশীল ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ভূমিকম্প মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি এবং ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্গঠন কর্মসূচি হাতে নেওয়া।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি