April 26, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, November 21st, 2021, 9:51 pm

মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে পাথরবিহীন রেলপথ

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে দেশের পাথরবিহীন রেলপথ। আর পাথরবিহীন রেলপথের কারণেই ট্রেনের প্রায় ৯০ শতাংশ লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। নিরাপদ রেলপথ নিশ্চিতে যথাযথ পাথর জরুরি। কিন্তু দেশের অনেক স্থানেই রললাইনে প্রয়োজনীয় পাথর নেই। কোথাও আবার পাথরের ছিটেফোঁটাও নেই, কোথাও শুধু মাটির ওপরে পড়ে আছে রেললাইন। আর পাথরবিহীন রেললাইনে উনিশ থেকে বিশ হলেই ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। তাতে প্রাণহানিসহ লোকসান গুনতে হচ্ছে। কিন্তু তারপরও রেল কর্তৃপক্ষের সেদিকে কোনো নজর নেই। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার ৪০৩ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক রয়েছে। ওসব ট্র্যাকে প্রায় ৩ যুগ ধরে পাথর স্বল্পতা বিরাজ করছে। পুরো রেলপথের কোথাও রেলওয়ের নিয়ম নির্দেশনা অনুযায়ী পাথর নেই। অথচ লাইনের ধরন অনুযায়ী স্লিপারের নিচে ৬ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত পাথর থাকতে হয়। একই সঙ্গে লাইনের দু’পাশে ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত পাথর থাকতে হয়। আর স্লিপারের মধ্যস্থলে পাথর সমান রাখতে হয়। বর্তমানে রেললাইনের কোথাও নিয়ম অনুযায়ী পাথর নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্লিপারের নিচে মাটি দেখা যায়। কোথাও কোথাও আগাছাও দেখা যায়। পুরো রেলপথে প্রায় দেড় কোটি ঘনফুট (সিএফটি) পাথরের প্রয়োজন হলেও রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ (সাড়ে ৭ লাখ ঘনফুট)। আর রেলপথে যৎসামান্য পাথর দেয়া হলেও দরপত্র থেকে শুরু করে পাথর ফেলা এবং সেকশন নির্বাচন নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে ১২০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক ট্রেন রয়েছে। কিন্তু পাথরবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ লাইন হওয়ায় ওসব ট্রেন গড়ে মাত্র ৬৭ কিলোমিটার গতি নিয়ে চলছে। রেলপথে পাথর সংকট দিন দিন চরমে উঠছে। কিন্তু নতুন নতুন প্রকল্পের কারণে বিষয়টি চাপা পড়ে যাচ্ছে। অথচ প্রতি বছর একটি লাইনে মোট পাথরের ৫ থেকে ১০ শতাংশ ফেলতে হয়। ওই হিসাবে বছরে প্রায় দেড় কোটি ঘনফুট (সিএফটি) পাথর প্রয়োজন। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের লাইনে ২৯ হাজার ঘনফুট এবং পূর্বাঞ্চলে ১৫ হাজার ঘনফুট পাথর ফেলা হয়। পাশাপাশি লাইনে পাথর দেয়া নিয়ে টেন্ডার থেকে শুরু করে পাথর ফেলা পর্যন্ত নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বেশ কয়েকজন রেলওয়ে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তও করছে। দিনের পর দিন পাথরবিহীন লাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে না। যাদের দায়িত্ব তারা এক থেকে দুবার ট্রলি দিয়ে রেলপথ পরিদর্শন করে তাদের দায়িত্ব শেষ করছে।
সূত্র আরো জানায়, গত অর্থবছরে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলের জন্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকার পাথর কেনা হয়। কিন্তু লাইনে ওসব পাথর ফেলা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। যথাযথভাবে পাথর না ফেলেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কতিপয় রেলওয়ে কর্মকর্তার সঙ্গে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে বিল তুলে নিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের ছেলে-ভাগ্নে থেকে শুরু করে দলীয় নেতারা পর্যন্ত পাথরের টেন্ডার ও মালামাল ক্রয়ের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের ইশারায় নির্ধারিত হচ্ছে কে টেন্ডার পাবে। রেলের ভারত, মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। ২-৩ গুণ বেশি দামেই পাথর আমদানি করতে হচ্ছে।
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন জানান, গত অর্থবছরে পূর্বাঞ্চল রেললাইনে ৮ লাখ ঘনফুট পাথর ফেলা হয়েছে। চাহিদার তুলনায় যা মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২০ লাখ ঘনফুট পাথর ফেলা। কিন্তু তাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। গত অর্থবছরে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার পাথর ফেলা হয়েছে। এবার লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। লাইনে নির্ধারিত পাথর দিতে হলে কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন। পর্যায়ক্রমে পাথর ফেললেও আগামী ১০ বছর সময় লাগবে। কারণ পাথর স্বল্পতা দীর্ঘদিনের। বর্তমান সরকার রেলে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। আর বরাদ্দ পেলে ধীরে ধীরে নির্ধারিত পাথর ফেলা সম্ভব হবে।
একই বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রেলপথ) মো. আসাদুল হক জানান, কেবল পাথরবিহীন রেলপথলাইনের জন্য বর্তমান সরকারের আমলে রেলবহরে যুক্ত হওয়া অত্যাধুনিক ট্রেনগুলোর গতি উঠানো সম্ভব হচ্ছে না। গত বছরে মাত্র ২৯ হাজার ঘনমিটার পাথর দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সেকশনে পাথরস্বল্পতা ভয়ানক রূপ নিয়েছে। সেকশন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের কাছ থেকে পাথরের চাহিদা নেয়া হচ্ছে। যে চাহিদা পাওয়া যাচ্ছে বরাদ্দ অনুযায়ী তা পূরণ করতে হলে যুগ পেরিয়ে যাবে। চলতি অর্থবছরে ৫০ হাজার ঘনমিটার পাথর ফেলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। গত বছর প্রায় ২৩ কোটি টাকার পাথর কেনা হয়েছে। ওই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মোহাম্মদ কামরুল আহসান জানান, রেলপথে পাথর স্বল্পতা বহু বছরের। প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম পাথর দেয়া হচ্ছে। তবে বরাদ্দ পেলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাথর লাইনে ফেলা হবে। লাইন যথাযথ রাখার অন্যতম মাধ্যম হলো লাইনে পর্যাপ্ত পাথর থাকা। আর তা নিশ্চিত করতেই হবে।
এ প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন জানান, নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সঙ্গে রেলপথকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যাত্রীসেবা বাড়াতে অত্যাধুনিক ট্রেন চালানো হচ্ছে। তবে নির্ধারিত গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ রেলপথের সমস্যা পুরোনো। রেলপথ সংস্কার ও পাথর দেয়ার বিষয়ে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় শতভাগ পাথর আমদানি করতে হচ্ছে। লাইনে পাথর ফেলা শুরু হয়েছে। আগামীতে বরাদ্দ আরো বাড়ানো হবে। তাছাড়া পাথর দেয়া নিয়ে টেন্ডার, লাইনে পাথর ফেলা এবং সংশ্লিষ্টদের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত পেলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।