অনলাইন ডেস্ক :
হাজার বছরের পুরোনো রেওয়াজ মেনে আড়ম্বর ও ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের রাজা হিসেবে আনুষ্ঠানিক অভিষেক হয়েছে তৃতীয় চার্লসের। গত শনিবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে তাঁকে শপথ পাঠ করান ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি। পরে তিনি তৃতীয় চার্লসের মাথায় রাজার মুকুট পরিয়ে দেন। শপথ অনুষ্ঠানে রাজপরিবারের সদস্য, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, ধর্মীয় নেতাসহ ২ হাজার ২০০ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। শপথ নিয়েছেন রাজা তৃতীয় চার্লসের স্ত্রী কুইন কনসর্ট ক্যামিলাও।
৭০ বছর ব্রিটেনের রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী হিসেবে কাটিয়েছেন চার্লস। এ সময়ে তাঁর মা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন সিংহাসনে। ১৯৫৩ সালে রানীর অভিষেক অনুষ্ঠানের পর সাত দশক পার হয়ে গেছে। প্রায় এক প্রজন্ম পর আবারও ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রাজপরিবারের অভিষেক অনুষ্ঠান হলো। আড়ম্বরের দিক থেকে খুব বেশি পিছিয়ে ছিল না তৃতীয় চার্লসের অনুষ্ঠানও। যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় অভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এর আগে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাকিংহাম প্যালেস থেকে স্বর্ণখচিত ঘোড়ার গাড়িতে রওনা করেন সস্ত্রীক চার্লস।
তাঁরা সাদা রঙের পোশাক পরিহিত ছিলেন। হাজার হাজার সজ্জিত সৈনিকের মধ্য দিয়ে তাঁদের ঘোড়ার গাড়ির শোভাযাত্রাটি যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন সড়কের পাশে ছিলেন অনেক দর্শক। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলেছে অভিষেক অনুষ্ঠান; যা বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আদ্যোপান্ত সরাসরি সম্প্রচার করেছে। অভিষেক অনুষ্ঠানে ছিল বহুজাতিক ও বহুমাত্রিক আবহ। এতে যোগ দিতে দেশ-বিদেশের নেতা ও তারকারাও ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে আগে থেকেই জড়ো হয়েছিলেন। শতাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও গণ্যমান্যরা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। এ সময় ব্রিটিশ সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকার প্রিন্স উইলিয়াম, তাঁর স্ত্রী কেট মিডলটনসহ রাজপরিবারের অন্য সদস্যরাও ছিলেন।
ছিলেন প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানার ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারিও। তবে তাঁর স্ত্রী মেগান মারকেলকে দেখা যায়নি। হ্যারি ও মারকেল যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হ্যারি লন্ডনে এলেও মারকেল আসেননি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন ও ইউক্রেনের ফার্স্ট লেডি অলিনা জেলেনস্কিও ছিলেন। শপথ গ্রহণের পর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে রাজা তৃতীয় চার্লস ও তাঁর স্ত্রী ক্যামিলা আবার বাকিংহাম প্যালেসে ফিরে যান। এ সময় রাজদম্পতিকে একনজর দেখার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়ান। শপথ অনুষ্ঠানে আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি বলেন, রাজার অভিষেক শপথের আইনি গুরুত্ব রয়েছে। নতুন রাজা যেন তাঁর শাসনকালে আইনের শাসন ও চার্চ অব ইংল্যান্ডের মর্যাদা সমুন্নত রাখেন। রাজা তৃতীয় চার্লস পবিত্র গসপেলে হাত রেখে শপথ নেন এবং আইনের শাসন ও চার্চ অব ইংল্যান্ডের মর্যাদা সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করেন। একজন ‘একনিষ্ঠ প্রটেস্ট্যান্ট’ হিসেবেও শপথ নিয়েছেন ৭৪ বছরের চার্লস।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে মারা যান রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রাজা তৃতীয় চার্লস তাঁর বড় ছেলে। তিনি যুক্তরাজ্য এবং আরও ১৫টি দেশের রাজা হলেন। রাজকীয় অনুষ্ঠানের জন্য টাওয়ার অব লন্ডনে যেসব সামগ্রী বা ক্রাউন জুয়েলস সংরক্ষিত আছে, সেন্ট এডওয়ার্ডের মুকুট তার মধ্যমণি। শুধু অভিষেকের মুহূর্তেই রাজা বা রানী এ মুকুট পরেন। ১০৬৬ সালে প্রথম উইলিয়ামের রাজ্যাভিষেকের পর থেকে চার্লসের পূর্বসূরি ৪০ জন রাজা-রানীর অভিষেক এ ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতেই হয়েছে। সর্বশেষ এখানে ১৯৫৩ সালে রানী এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান হয়। রয়টার্স জানায়, হাজার বছরের পুরোনো রেওয়াজের সঙ্গে আধুনিক ব্রিটেনের রীতির সমন্বয়ে তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছে। যুগে যুগে ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে বদলেছে অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রকৃতি। চার্লস খ্রিষ্টধর্মের পাশাপাশি অন্য ধর্মগুলোকেও সুরক্ষা দেবেন।
আড়ম্বর অভিষেক অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। তিনি বলেন, ‘অন্য কোনো দেশ এমন জমকালো প্রদর্শনী করতে পারেনি- রাজ-শোভাযাত্রা, সমারোহ, আনুষ্ঠানিকতা ও স্ট্রিট পার্টি। এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গর্বিত প্রকাশ। আমাদের আধুনিক চরিত্রের প্রাণবন্ত প্রদর্শনী। এটি একটি লালিত আচার, যার মাধ্যমে একটি নতুন যুগের জন্ম হয়।’ অভিষেকের এ আড়ম্বরে কিছু বিড়ম্বনাও দেখা গেছে। অনুষ্ঠানকে ঘিরে বিক্ষোভ করেছে রাজতন্ত্রবিরোধী গ্রুপ রিপাবলিক। লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বিক্ষোভকালে গ্রুপটির সিইও গ্রাহাম স্মিথসহ ছয় নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিক্ষোভকারীরা ‘আমার রাজা নন’ লেখা গেঞ্জি পরিহিত ছিলেন।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এসব গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, ‘এভাবে লোকজনকে গ্রেপ্তারের ঘটনা মস্কোতে ঘটে। লন্ডনে এটা আশা করি না।’ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের যুক্তরাজ্য শাখার পরিচালক ইয়াসমিন আহমেদ বলেন, অভিষেকের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভের কারণে লোকজনকে গ্রেপ্তারের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। রাজার অভিষেক একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। এর খরচ বহন করে সরকার। অনুষ্ঠানে কারা অতিথি হবেন- সেটা রাজপরিবারের অনুমতিক্রমে সরকারই নির্ধারণ করে। ব্রিটিশ রাজা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তবে তিনি রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকেন। তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানে এবার কোহিনুর হীরার ব্যবহার করা হয়নি। এ হীরার সঙ্গে ব্রিটিশ রাজপরিবারের নানা ইতিহাস জড়িত। অনেকে এটাকে ‘অভিশপ্ত’ বলে বর্ণনা করেন।
ব্রিটিশ রাজপরিবারের পরবর্তী উত্তরাধিকার রাজা চার্লস ও তাঁর প্রথম স্ত্রী প্রিন্সেস ডায়ানার বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম। রানীর মৃত্যুর পর তিনি হন প্রিন্স অব ওয়েলস এবং ডিউক অব কর্নওয়াল। ডিউক অব কেমব্রিজের আগের মর্যাদাও তাঁর রয়েছে। ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারের তালিকায় তিনি এখন এক নম্বরে। তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন প্রিন্সেস অব ওয়েলস, ডাচেস অব কর্নওয়াল ও ডাচেস কেমব্রিজ। তাঁদের তিন সন্তান- প্রিন্স জর্জ, প্রিন্সেস শার্লট ও প্রিন্স লুইজ।
এক জরিপের ভিত্তিতে সিএনএন জানিয়েছে, গত এক দশকে ব্রিটিশদের মধ্যে রাজপরিবার সম্পর্কে মনোভাব আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। এটা রাজা চার্লসের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যুক্তরাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক (৩৬) মনে করেন, গত ১০ বছরে রাজপরিবার সম্পর্কে তাঁদের ধারণা আরও বেশি নেতিবাচক হয়েছে। কেবল ২১ শতাংশ বলেছেন, রাজপরিবার সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ইতিবাচক হয়েছে। ৪১ শতাংশ ব্রিটিশ মনে করেন, তাঁদের ধারণা অপরিবর্তিত আছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২