নিজস্ব প্রতিবেদক:
পর্যটন একটি বহুমাত্রিক শিল্প-জাতিগত সংযোগ, সৌন্দর্য, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির অনুপম মাধ্যম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পর্যটন শিল্প মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান বাহন একটি। সারা বিশ্বে কর্মসংস্থান ও আয়বর্ধনে বহুমাত্রিক পর্যটন ও সেবা শিল্প বিশাল ভূমিকা পালন করছে। জনবহুল এ দেশেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প এক অমিত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
করোনা মহামারীর এই দীর্ঘ সময়ে পর্যটন খাত বেশ চরাই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। এই সংকটকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পর্যটন খাত। করোনা মহামারী এখনো পুরোপুরি নিঃশেষিত হয়নি। এর নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন পর্যটন খাতের জন্য নতুন হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। জানা যায়, দৈনিক শনাক্তের হার ১৪ শতাংশের কাছাকাছি। দেশে এখন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করোনা রোগীই ওমিক্রনে আক্রান্ত। এক সপ্তাহে দেশে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ইতোমধ্যে পর্যটন শিল্পেও এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের পর্যটন খাতও বর্তমানে করোনার ধাক্কায় নিষ্পেষিত। এ খাতে এক ধরণের ভাঁটা পড়েছে, এবং এই খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও পড়েছে ক্ষতির মুখে। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে ঘুরতে আসেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। কিন্তু এ বছর প্রথম থেকেই বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা তাদের বুকিং বাতিল করছেন। দেশের পর্যটন খাতের একটি বড় অংশ চীনা নাগরিকরা। এবার তারাও আসতে পারছেন না। তা ছাড়া দেশীয় পর্যটকের সংখ্যাও করোনাভাইরাসের প্রভাবে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, যা পর্যটনসংশ্নিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। সন্দেহ নেই, এর নেতিবাচক কমবেশি প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।
জানা যায়, করোনা মহামারি শুরুর আগে ২০১৯ সাল ছিল পর্যটনের জন্য সবচেয়ে ভালো বছর। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল পর্যটন শিল্প থেকে। অর্থাৎ জিডিপিতে অবদান ছিল ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। পাশাপাশি একই বছর পর্যটন শিল্পে মোট ৩৩৪ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা মোট কর্মসংস্থানের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্বের ৫১টি দেশের প্রধান শিল্প হচ্ছে পর্যটন শিল্প এবং সব উন্নত দেশের প্রধান পাঁচটি শিল্পের মধ্যে থাকে এ শিল্প। বিগত দুই দশক ধরে পর্যটন শিল্প বিশ্বব্যাপী সব অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়নের মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। তা ছাড়া মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ তৈরি হয় এ খাতে। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের মতে, ২০২০ সালে পর্যটন শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সাল থেকে প্রায় ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ কম। এর ধাক্কা লেগেছে কর্মসংস্থানেও। ২০২০ সালে পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে মাত্র ২৭২ মিলিয়ন, যা ২০১৯ সালের চেয়ে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ কম। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
করোনা মহামারীর আগে বাংলাদেশের পর্যটন খাত বেশ স্বাস্থ্যবান ছিল। ২০২০ সালে করোনার প্রভাবে জিডিপিতে পর্যটনের অবদান প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ওই বছর পর্যটনের অবদান ছিল ৪৬০০ বিলিয়ন ডলার, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। করোনার প্রভাব কর্মসংস্থানও করেছে নিম্নমুখী। ২০২০ সালে প্রায় ৬২ মিলিয়ন লোক পর্যটন খাত থেকে চাকরি হারিয়েছে। এর প্রভাব ২০২১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত আছে। করোনার প্রকোপ মাঝেমধ্যে কমে গেলে কিছুটা সীমিত পরিসরে পর্যটন চালু থাকলেও তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হংকংয়ে জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ৪১ শতাংশ হ্রাস পায়। সিঙ্গাপুরের পর্যটন খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যায় প্রায় ২৫ শতাংশ। করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কার প্রভাবে চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশে পর্যটনে ধস নেমেছে, যা আগেরবারের চেয়ে আরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে থাইল্যান্ড প্রায় ১০৯ বিলিয়ন থাই বাথ লোকসানের মুখে পড়েছে করোনাভাইরাসের কারণে। ইন্দোনেশিয়াতে করোনাভাইরাসের কারণে দেশটির চার বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যিক ক্ষতি বা লোকসান হয়েছে। তা ছাড়া সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশও এর বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্তি পায়নি। ২০২২ সালে এসেও করোনার প্রকোপে প্রায় বিপর্যস্ত হতে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশকে। বর্তমানে ভারতে করোনার ভয়াবহ রূপ দেখা যাচ্ছে, যা চরম উদ্বেগের কারণ। এর ফলে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ।
তবে সুখের সংবাদ এই যে, চলতি বছরটি হবে পর্যটন খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর বছর। দুই বছর ধরে জমিয়ে রাখা পরিকল্পনাগুলো এবারই বাস্তবায়ন করতে পারবেন ভ্রমণপিপাসুরা। এরইমধ্যে অনেক আন্তর্জাতিক গন্তব্য পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে, শিথিল হয়েছে কোয়ারেন্টিন নীতিমালা। পর্যটকদের প্রত্যাশা এ বছর পূরণ হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এরইমধ্যে মহামারী থেকে পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটতে শুরু করেছে বিশ্বের পর্যটন খাত। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের মোট অবদানের পরিমাণ হবে ৮ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০১৯ সালে যা ছিল ৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন। কিন্তু ২০২০ সালে মহামারী শুরু হলে রীতিমতো ধস নামে এ খাতে। প্রায় ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার লোকসান গুনতে হয় বিশ্বের পর্যটন খাতকে। ডব্লিউটিটিসি বলছে, যদি পুনরুদ্ধারের গতি বাড়তে থাকে তাহলে প্রাক-মহামারীকালের তুলনায় বৈশ্বিক জিডিপিতে এ খাতের অংশগ্রহণ বাড়বে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ