নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের নৌপথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মাত্রাতিরিক্ত অনিবন্ধিত নৌযানের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে সারাদেশে ট্রলার, স্পিডবোট, বালুবাহী বাল্কহেড মিলে নিবন্ধিত নৌযানের চেয়ে অনিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যাই বেশি। ফলে আশঙ্কাজনক হারে নৌপথে নৌযান দুর্ঘটনা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। আর মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে নদীপথে প্রতিদিন চলছে ইঞ্জিন চালিত নৌযান। অতিসম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বালু বোঝাই ট্রলারের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রলার দুর্ঘটনায় ২২ জনের সলিল সমাধি ঘটেছে। আর ১৯৯১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ৩০ বছরে প্রায় ১ হাজার ছোটবড় নৌ-দুর্ঘটনায় ৪ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। ওসব নৌযান দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ১ হাজারের বেশি মানুষ। আর নিখোঁজ হয়েছে ৫ শতাধিক মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কোটি কোটি টাকা। নৌ-মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারাদেশে গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৪৮৬টি। আর হাজার হাজার অনিবন্ধিত ট্রলার, বালুবাহী জাহাজ, স্পিডবোট নৌপথে চলাচল করছে। সরকারি কোনো সংস্থার কাছেই সারাদেশে অনিবন্ধিত নৌযানের কোনো পরিসংখ্যান নেই। কোন অঞ্চলের নদ-নদীতে কি ধরনের যাত্রী বা পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে তারও কোন তথ্যভান্ডার নেই। অবৈধ ওসব নৌযান চলায় একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে নৌ-খাতে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনাও। নিয়মানুযায়ী নৌযানের নক্সা নৌ-পরিবহন অধিদফতর থেকে অনুমোদনের পরই নৌপথে নৌযান চলাচল করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে অনুমোদনহীন বা লাইসেন্সবিহীন নৌযান সংখ্যার ছড়াছড়ি। এতো কিছুর পরও নির্বিকার কর্তৃপক্ষ। আইনগতভাবে নিবন্ধনহীন ১৬ হর্স শক্তির বেশি ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সূত্র জানায়, একাধিক কারণে দেশে নৌ-দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নৌযান চালকের অদক্ষতা, কারিগরি ত্রুটি, ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ-তিনগুণ যাত্রী বহন, চলার পথে প্রতিযোগিতা, ফিটনেসের অভাব, বেপরোয়াভাবে নৌযান চালানো, পর্যাপ্ত লাইফবয়া না থাকা। তবে চালকের অদক্ষতা ও ত্রুটিপূর্ণ যানের কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। নৌযানের সার্বিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব সরকারের দুই সংস্থা হচ্ছে নৌ-মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ-পরিবহন অধিদফতর। সংস্থা দুটির সংশ্লিষ্টদের মতে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত ১৩ হাজার ৪৮৬টি নৌযান ছিল। তবে তার বেশি রয়েছে অনিবন্ধিত নৌযান। আর নৌযান মালিক ও শ্রমিক নেতাদের মতে, সারাদেশে অনিবন্ধিত বালুবাহী (বাল্কহেড) জাহাজ, ট্রলার ও স্পিডবোট মিলিয়ে অন্তত ২০ হাজার নৌযান চলাচল করছে। আইনগতভাবে নিবন্ধনহীন ১৬ হর্স শক্তির বেশি ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ-পরিবহন অধিদফতর ছাড়াও নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড ও স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই প্রভাবশালীদের মাধ্যমে অবৈধ ওসব নৌযান চলছে। আর তারাই প্রভাবশালী যে, তাদের কাছে যারা নিয়ম মেনে নৌযান পরিচালনা করছে তারা অসহায় হয়ে পড়ছে। যদিও নিবন্ধনহীন অবৈধ নৌযান চলাচল করার সুযোগ দেয়ার জন্য পরস্পরকে দুষছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুই সংস্থার সংশ্লিষ্টরা। একপক্ষের মতে, মাওয়া (শিমুলিয়া), বাংলাবাজার (মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী), পাটুরিয়া, দৌলতদিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বিআইডব্লিউটিএ’র ঘাট ব্যবহার করে অসংখ্য অনিবন্ধিত নৌযান চলাচল করছে। সংস্থাটি ওসব ঘাট ইজারা দিয়েও রাজস্ব আদায় করছে। অনিবন্ধিত নৌযান চলাচল বন্ধ করতে বিআইডব্লিউটিএকে নৌ পরিবহন অধিদফতর চিঠি দিয়েছে। অপরপক্ষের মতে, সব নৌযান নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদের আওতায় আনতে না পারা নৌ-পরিবহন অধিদফতর ব্যর্থতা। দেশে কত সংখ্যক বৈধ-অবৈধ নৌযান চলাচল করছে ওই সংখ্যা বের করতে ২০১৬ সালে নৌযান শুমারির উদ্যোগ নেয়া হলেও ওই প্রকল্পটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
সূত্র আরো জানায়, নিবন্ধনহীন বাল্কহেড সারাদেশে নৌপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রাতে ওসব নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু দিন-রাত সমানভাবে চলাচল করছে ওই নৌযান। ওসব নৌযানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাতি নেই। বালি পরিপূর্ণ অবস্থায় ওসব নৌযানের শুধু সামনের কিছু অংশ ও পেছনের অংশ পানির উপরে থাকে। ফলে কোন কারণে বাল্কহেডের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে তা ডুবে গিয়ে শত শত মানুষের প্রাণহানির শঙ্কা নিয়েই অন্যান্য নৌযান চালাতে হয়। প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে চলা ওসব বাল্কহেডের বিরুদ্ধে কিছু বললেই নানা হেনস্থা শিকার হতে হয়। সারাদেশে অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার নিবন্ধনহীন বাল্কহেড চলাচল করছে।
এদিকে নৌ-পরিবহন অধিদফতরের তথ্যমতে, ১৯৯১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে ৯০২টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭৩৫ জন মারা গেছে। ওসব ঘটনায় আহত হয়েছে ৯২৬ জন এবং নিখোঁজ হয়েছে ৫০১ জন। নিয়মানুযায়ী নৌযানের নক্সা নৌ-পরিবহন অধিদফতর থেকে অনুমোদনের পর ওই নক্সা অনুযায়ী নৌযান নির্মাণ করতে হবে। আর সার্ভেয়াররা নির্মিত নৌযান পরিদর্শন করে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদ দেয়। ওই সনদ দুটি দেখিয়ে বিআইডব্লিউটিএ থেকে রুট পারমিট নিতে হয়। তারপরই নৌযান চলাচলের জন্য উপযুক্ত হয়। বর্তমানে বিআইডভিøউটিএ শুধু যাত্রীবাহী ৭৮০টি নৌযানের রুট পারমিট দিয়েছে। তবে ফি অনুমোদন না পাওয়ায় পণ্যবাহী নৌযানের রুট পারমিট দেয়া শুরু করেনি। বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত নৌযান রয়েছে ১৩ হাজার ৪৮৬টি। তার মধ্যে যাত্রীবাহী লঞ্চ ৮৩৮টি, যাত্রীবাহী বোট ৪১৭টি, স্পিডবোট ৩৪০টি, মালবাহী জাহাজ ৩ হাজার ৩৬৭টি, বালিবাহী ৫ হাজার ৭১টি, ড্রেজার ১ হাজার ৩৫২টি। তার বাইরে কতটি নৌযান নিবন্ধন ছাড়াই চলাচল করছে তা নিরূপণে ২০১৬ সালে ন্যাশনাল শিপস এ্যান্ড মেকানাইজড বোটস ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং নামের একটি প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করেছিল নৌ-পরিবহন অধিদফতর। ওই সময়ে ৪৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৩ বছরে সারাদেশের নৌযানের ডাটাবেজ তৈরির কথা ছিল। কিন্তু ওই ডিপিপি এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি। ফলে নিবন্ধনহীন নৌযানের সঠিক কোন পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের ৮১ ধারা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএর ৪৭ কর্মকর্তাকে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইনগত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা খুব কমই ওই আইনের প্রয়োগ করছে। অনেক ক্ষেত্রেই নিবন্ধনহীন জাহাজ থেকে কনজারভেন্সি চার্জ আদায়ের মাধ্যমে কোন কোন কর্মকর্তা তাদের বৈধতা দেয়। খুলনা, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ, রাঙামাটি, ভৈরবসহ কয়েকটি এলাকায় এভাবে কনজারভেন্সি চার্জ নেয়া হয়েছে। তাছাড়া বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির অনেক জাহাজেরই নিবন্ধন নেই।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম