নিজস্ব প্রতিবেদক:
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সারাদেশে ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে গনপরিবহণ বন্ধ করে দেয় বাস মালিক সমিতি। তাদের প্রত্যাশিত ২৭ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, এবং বিআইডব্লিউটিএ’র বৈঠকে লঞ্চের ভাড়া ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বৃদ্ধির পর নৌ-ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এর মধ্যদিয়ে দেশে তিন দিনের জিম্মিদশার অবসান হলো। রোববার সন্ধ্যা থেকেই রাজধানীতে কিছু বাস চলাচল শুরু করে। পাশাপাশি ঢাকা থেকে ছেড়ে গেছে দূরপাল্লার অনেক বাস। সোমবার সকাল থেকে পুরোদমে নতুন ভাড়ায় বাস ও লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে।
বাস ও লঞ্চ মালিক সমিতির নেতারা দাবি করেছিলেন তারা ‘ধর্মঘট’ ডাকেননি। ধর্মঘট না ডাকলে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন কেমন করে? এ প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে। বাস ধর্মঘটের পথ ধরে নৌ-ধর্মঘট এবং ট্রাক মালিকরা পণ্য পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেন।
অনেকে মনে করছেন, পরিবহণ মালিকদের ডাকা এই ধর্মঘট ছিল সাজানো নাটক। জনগণকে জিম্মিদশায় ফেলতেই বাস-লঞ্চ মালিক ও প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা তেলের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন ঠেকাতে এই নাটক মঞ্চস্থ করলেন। সে জন্যই বাস-লঞ্চ চলাচল বন্ধের পর সরকারি পর্যায় থেকে গণপরিবহন চালানোর কোনো রকম উদ্যোগ দেখা যায়নি।
পরিবহণ মালিকদের ডাকা অকস্মাৎ ধর্মঘটে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েন দেশের সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে সারাদেশ থেকে ঢাকায় আসা লাখ লাখ পরীক্ষার্থী জিম্মিদশায় পড়েন। রাস্তায় বাস চলাচল বন্ধ থাকায় ছোট ছোট পরিবহনগুলো যাত্রীদের জিম্মি করে ৪ থেকে ১০ গুণ বেশি ভাড়া আদায় করে। বাধ্য হয়েই লাখ লাখ পরীক্ষার্থী ও কর্মজীবী মানুষ অধিক ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করেন। অতঃপর ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির পর বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পর বাস ধর্মঘট তুলে নেয়া হয়।
এই নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া নিলে জনস্বার্থে সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার সকালে নিজ বাসভবনে ব্রিফিংকালে একথা জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া যেন যাত্রীদের থেকে কোনভাবেই আদায় করা না হয়। এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে জনস্বার্থে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।
তিনি বলেন, গ্যাস অকটেন ও পেট্রোল চালিত যানবাহনের ক্ষেত্রে বর্ধিত এ ভাড়া প্রযোজ্য হবে না। ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের ধর্মঘটের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বসে সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন।
এদিকে, ভাড়া বাড়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন যাত্রীরা। রামপুরা থেকে ফার্মগেট যাওয়ার পূর্বের ভাড়া ছিল ২০ টাকা। সোমবার থেকে যাত্রীদের দিতে হচ্ছে ৩০টাকা। অর্থাৎ নতুন ভাড়ায় যাত্রীদের ১০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। এ নিয়ে বাসের কন্ডাক্টর-হেলপারের সঙ্গে বাকবিত-া হতে দেখা যায়। যাত্রীদের ক্ষোভ, ‘চাকরিজীবী মানুষের যে বেতন বাড়ছে না, সেটি নিয়ে কেউ কথা বলে না। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তার ওপর আবার যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি।’ আবার খিলক্ষেত থেকে ফার্মগেট আসতে ১৫ টাকার স্থানে ২৫ টাকা দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও ১০ টাকা ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বেশিরভাগ বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে। অথচ রোববার সন্ধ্যায় নতুন ভাড়া নিয়ে জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকার স্থলে ১০ টাকা এবং মিনিবাসে ৫ টাকার স্থলে ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি নিয়ম না মেনে বাসের কন্ডাক্টর-হেলপাররা ইচ্ছে মতো ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ করছেন বিভিন্ন রুটের যাত্রীরা। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে স্টুডেন্ট ভাড়াও নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছন অনেক শিক্ষার্থী।
বাস মালিক সমিতির সঙ্গে বিআরটিএ বৈঠকের পর ঘোষণা দেয়া হয়েছে শুধু ডিজেল দিয়ে চালিত গণপরিবহনের ভাড়া ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলো। সিএনজিচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া আগের মতোই থাকবে। সরকারের দায়িত্বশীল আমলারা এ ঘোষণা দিলেও বাস মালিকরা ইতোমধ্যে সব বাসই ডিজেলে চলে দাবি করে নতুন ভাড়া আদায় করতে শুরু করেছে।
জানা যায়, রাজধানী ঢাকার সব রুটে সাড়ে ১২ হাজারের মতো বাস চলাচল করে। এর মধ্যে মাত্র ৬২৬টি বাস ডিজেলচালিত। বাকি প্রায় ১২ হাজার (৯৫ শতাংশ) বাসই সিএনজিচালিত। আবার সারাদেশে চলাচল করা ৭৮ হাজার বাসের মধ্যে ৪৬ হাজার ৮০০ বাস চলে গ্যাসে। গ্যাসে চালিত বাসের ভাড়া বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি তারাও সব বাসের ভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করছেন।
বিআরটিএ ও বুয়েটের তথ্যমতে, ঢাকা শহরের প্রায় ৯৫ শতাংশ বাসই চলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে। দূরপাল্লার বাসের মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের চলাচলও গ্যাসনির্ভর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছাড়া দূরপাল্লার অন্য বাসের ৬০ শতাংশ গ্যাসে চলাচল করে। তবে পণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত প্রায় সব গাড়িই ডিজেলে চলে। ভাড়া বাড়ানোর থেকে ডিজেলের দাম কমানোর বিষয়ে জোর দিচ্ছেন পণ্যবাহী ট্রাকের মালিকরা। পণ্য ও গণপরিবহন মালিক সমিতির সূত্র বলছে, বর্তমানে পণ্য পরিবহন খাতে তিন লাখ ৫১ হাজার ৭৩টি নিবন্ধিত গাড়ি আছে। এর মধ্যে বাস ও মিনিবাস রয়েছে ৭৮ হাজার। এসবের প্রায় ৪০ শতাংশ ডিজেলে চলে। বাকি ৬০ শতাংশ বাস চলে গ্যাসে।
ঢাকায় বিআরটিএর অনুমোদিত বাস রয়েছে ১২ হাজার ৫২৬টি। বুয়েটের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এসব বাসের ৯৫ শতাংশই চলে গ্যাসে। সেই হিসাবে ঢাকায় মাত্র ৬২৬টি বাস ডিজেলে চলাচল করে। বাকি ১১ হাজার ৯০০ বাস গ্যাসে চলে। আর ঢাকা থেকে দূরপাল্লায় চলাচল করে ১৬ হাজার বাস। এর মধ্যে গ্যাসে চলে ১১ হাজার ২০০ বাস। আর ডিজেলে চলে ৪ হাজার ৮০০ বাস। অন্যদিকে সারাদেশে চলাচল করা ৭৮ হাজার বাসের মধ্যে গ্যাসে চলে ৪৬ হাজার ৮০০ বাস। আর ডিজেলে চলে ৩১ হাজার ২০০ বাস। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ভাড়া বৃদ্ধি বা ডিজেলের দাম কমানোর এই মারপ্যাঁচে ভুগছে সাধারণ মানুষ। কারণ ঢাকায় চলা ৯৫ শতাংশ বাসে ভাড়া বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এগুলো সব গ্যাসে চলে। যেসব বাস ডিজেলে চলে সেগুলো সরকারকে চিহ্নিত করতে হবে।
এদিকে, লঞ্চের ভাড়া পুনর্নির্ধারণের পর রাত থেকে শুরু হয়েছে লঞ্চ চলাচলও। রাজধানী সদরঘাটসহ বিভিন্ন ঘাট থেকে রাতেই বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায় লঞ্চগুলো। সকালে এসব লঞ্চ নির্দিষ্ট গন্তর্ব্যে পৌঁছায়। লঞ্চের নতুন ভাড়াকেও অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেছেন যাত্রীরা।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম