নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনাকে কেবল দুর্ঘটনা বলে আখ্যায়িত করার অবকাশ নেই। কেননা দুর্ঘটনা কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তা অকস্মাৎ আঘাত হানে। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি বলতে গেলে এক ধরণের অপরাধ পর্যায়ে চলে গেছে। নানা খামখেয়ালীপনা, অনিয়ম, আইনহীনতার কারণে এদেশের সরকে ঝরে পড়ছে তাজা অসংখ্য প্রাণ।
এটি সত্যি মেনে নেওয়া কষ্টকর যে, দুর্ঘটনা ঘটার পর এ নিয়ে কিছুদিন আলাপ-আলোচনা হয়, তারপর থেমে যায়। পরবর্তী দুর্ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত চৈতন্য জাগ্রত হয় না। অথচ এই চলমান দুর্ঘটনা জাতীয় জীবনে দুর্যোগ হয়ে রয়েছে। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের যেন কোনো উপায় নেই।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ নষ্ট হয়, যার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৫ হাজার মানুষ। আর দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সঙ্গতকারণেই এই সমস্যা থেকে মানুষজনকে মুক্ত রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণ রয়েছে। তবে অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হলো পরিবহণ চালকদের অদক্ষতা। রাস্তায় তাদের বেপরোয়া মনোবৃত্তি দুর্ঘটনার জন্ম দেয় বেশি। এই বেপরোয়া গাড়ি যারা চালান তাদের অনেকেই মাদকাসক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি মগবাজারে দুই বাসের রেষারেষিতে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। ঐ দুই বাসের চালককে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এদের একজন মাদকাসক্ত। ফলে বিআরটিএ এবার এই মাদকাসক্ত চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, চালকদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য ডোপ টেস্ট পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআরটিএ। ডোপ টেস্ট ছাড়া কোনো পেশাদার চালক আর লাইসেন্স পাবেন না। এমনকি নবায়ন করতে গেলেও লাগবে ডোপ টেস্ট। যদিও বিআরটিএর এই ঘোষণার বিষয়টি জানেন না অধিকাংশ চালক। এ নিয়ে কোনো প্রচারণারও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাসমালিকরা বলছেন, এটা বাস্তবায়নের আগে প্রচারণা দরকার। চালকদের মধ্যে সচেতনতা দরকার। চালকদের অনেকেও এই ডোপ টেস্টের পক্ষে।
বিআরটিএর এই পদক্ষেপকে দেশের অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন। এটি একটি ভালো পদক্ষেপ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।মাদকাসক্ত চালকদের প্রতিহত করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।বিআরটিএর নির্দেশনা অনুযায়ী জানা যায়, ঢাকায় এই ডোপ টেস্টের জন্য ছয়টি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদিত কোনো ল্যাব বা প্রতিষ্ঠান থেকেও ডোপ টেস্ট করা যাবে। ঢাকার হাসপাতালগুলো হলো, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেন্স সেন্টার, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। এই ডোপ টেস্টের কারণে পেশাদার চালকদের লাইসেন্স পেতে বা নবায়ন করতে অতিরিক্ত ৯০০ টাকা লাগবে।
এটি স্পষ্ট যে একজন পরিবহন চালককে সবসময় সজাগ থাকতে হয়। তাঁর দৃষ্টি থাকতে হয় বাজপাখির মতো একনিষ্ঠ। এ ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত চালকের কাছ থেকে এমন উদ্যম আশা করা অকল্পনীয়। এজন্য দেখা যায়, অধিকাংশ দুর্ঘটনাকবলিত পরিবহনের চালক মাদকাসক্ত হয়ে থাকে। বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, চালকদের ৮৯ ভাগেরই মাদকের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। এদের কেউ সেবন করেন, কেউবা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে চালকদের অনেকের দাবি, পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে চালক ও শ্রমিকেরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, দীর্ঘক্ষণ পথের মধ্যে থাকাই এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন তারা। ডোপ টেস্টের ব্যাপারে তারা অবশ্য এখনো জ্ঞাত নয়। এ ব্যাপারে একজন পরিবহন চালকের ভাষ্য, ডোপ টেস্ট করা হবে সেটা তো এখনো আমরা জানি না। কোথায় ডোপ টেস্ট করা যাবে তাও জানি না। তবে তিনি স্বীকার করেন, ডোপ টেস্ট করা হলে চালকদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা অনেকাংশে কমে যাবে।
এতে কোন দ্বিমত নেই যে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে অতীতেও বহু কথা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। বাস্তবে দেখা গেছে, এতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। মাঝে মাঝে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হাকডাক দিয়ে কাজ শুরু করলেও, কিছুদিন না যেতে তার কোনো খবর থাকে না। আরেকটি মর্মস্পর্শী দুর্ঘটনা ঘটলে বা কোনো বিশিষ্ট জনের মৃত্যু হলে, পুনরায় তোড়জোড় শুরু হয়। দুর্ঘটনার মূল কারণ যে বেপরোয়া চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি, তা অনেক আগেই চিহ্নিত হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, সড়ক-মহাসড়কের ত্রুটি। নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে লাইসেন্সকৃত গাড়ির সংখ্যা ২১ লাখ এবং অবৈধ গাড়ির সংখ্যা ১০ লাখ। আরেক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের গাড়ি চালকদের শতকরা ৮০ ভাগেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নাকি ভুয়া। এই ভুয়া লাইসেন্সধারীরা আবার মন্ত্রী-এমপিদের পৃষ্ঠপোষকতাও পাচ্ছে। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তবে দুর্ঘটনার সংখ্যা কি কমার কোনো কারণ আছে? আশা ও স্বপ্নের সমাধি হওয়া কি ঠেকানো যাবে? অনেকে ভাবতে পারেন, এই পরিস্থিতিতে প্রতিদিন সড়ক-মহাসড়কে লাশের পর লাশ পড়ে থাকার কথা! এ তুলনায় তো কমই হচ্ছে। রুঢ় হলেও বাস্তবতা এটাই। এই বাস্তবতা কচু গাছ কাটতে কাটতে ডাকাত হওয়ার মতো। অর্থাৎ নবিশ ও ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকরা দুর্ঘটনা ঘটাতে ঘটাতে দক্ষ হয়ে উঠেছে। যাকে বলে স্বশিক্ষিত। স্বশিক্ষিত ও প্রশিক্ষিতদের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে, তা ঐসব বেপরোয়া গাড়ি চালকরা মানতে চায় না।
ডোপ টেস্ট সড়কে চালকদের মধ্যে একটা ফিল্টার হিসেবে কাজ করবে যদি এই উদোগ ভালোভাবে কার্যকর হয়। এজন্য ব্যাপক প্রস্তুতি দরকার। কেননা প্রস্তুতি না নিয়ে এটা করা হলে চালকেরা বিকল্প পথে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। এতে ভুয়া বা অবৈধ লাইসেন্স বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ