March 29, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, January 10th, 2022, 8:59 pm

মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত দেশের সিংহভাগ মানুষই

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক :

বিশ্বে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। নতুন নতুন আবিষ্কার আর অক্লান্ত গবেষণায় অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা সম্ভবপর হচ্ছে। তবে অন্যান্য দেশগুলো মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পারলেও বাংলাদেশ সেদিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনিয়ম আর বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালগুলোতে অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে হিমশিম খেতে হয় সাধারণ মানুষকে। এজন্য রোগে আক্রান্ত হলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকের কাছে যায় না। ৫৮ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেয় ওষুধের দোকানদার, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, হাকিম-কবিরাজ, ওঝা, পীর, বৈদ্যসহ অন্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে। এ কারণে অর্ধেকের বেশি রোগী সুচিকিৎসা পায় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ থেকে এসব তথ্য জানা যায়। বিবিএস’র ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় গত বছর। সেখানে দেখা যায়, ১৬ শতাংশ রোগী সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে উপজেলা-জেলাসহ বিভিন্ন স্তরের হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। ২৬ শতাংশ রোগী সেবা নেয় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে। বেশ কিছু রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। বিবিএসের রোগগ্রস্তবিষয়ক জরিপ (২০১৪) বলছে, প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে ১৭০ জন কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত থাকে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় জ¦রে। অন্যদিকে গেঁটেবাত, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, ক্যানসারÑএসব অসংক্রামক রোগ আগের চেয়ে বাড়ছে। তবে রোগে ভুগলেই সব মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায় না। প্রায় ৫৮ শতাংশ মানুষ মনে করে, সমস্যাটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্য একটি অংশ চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে চিকিৎসা নেয় না। এরা প্রায় ১৭ শতাংশ। বাড়ির কাছে হাসপাতাল বা চিকিৎসক না থাকার কারণে অনেকে চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকে। অনেকে মনে করে, চিকিৎসকের কাছে গেলে বড় কোনো রোগ ধরা পড়তে পারে। এই আতঙ্কেই অনেকে চিকিৎসকের কাছে যায় না। এমনও হয় যে সঙ্গে যাওয়ার লোক থাকে না বলে অনেকে চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে যায় না। চিকিৎসা না নেওয়ার এই প্রবণতা নারী ও পুরুষের মধ্যে যেমন আছে, তেমনি আছে শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে। বিবিএসের সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে দেখা যাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, বিশেষায়িত হাসপাতালে, বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রতিষ্ঠানে ও যোগ্য চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ৪২ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেয়। এর অর্থ, বাকি ৫৮ শতাংশ রোগী বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে নিবন্ধিত নন, এমন চিকিৎসক ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভাষায় ‘অযোগ্য চিকিৎসক’দের ব্যক্তিগত চেম্বারে ২৩ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেয়। ওষুধের দোকানদার বা কর্মচারী ও কম্পাউন্ডাররা সবচেয়ে বেশি মানুষকে চিকিৎসা দেন। চিকিৎসা নিতে আসা ৩৩ শতাংশ রোগী তাঁদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়। ২ দশমিক ২৩ শতাংশ রোগী যায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিতে। হেকিম ও কবিরাজের কাছে যায় দশমিক ৭৬ শতাংশ রোগী। তবে যারা চিকিৎসা নিতে যায়, তারা রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরপরই চিকিৎসার জন্য যায় না। রোগে আক্রান্ত হওয়ার গড়ে চার দিন পর তারা চিকিৎসার জন্য যায়। অন্যদিকে প্রয়োজনের ৯৩ শতাংশ ওষুধ মানুষ দোকান থেকে কেনে। সরকারি হাসপাতাল থেকে মাত্র ৩ শতাংশ ওষুধ রোগীরা পায়। এদিকে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় জানা গেছে, সেবার মান বাড়ার পরও দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা ৯৩ শতাংশ রোগী কোনো ওষুধ পায় না। প্রায় ৮৫ শতাংশ রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে ছুটতে হয় বেসরকারি হাসপাতালে। গত নভেম্বরে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা খাতে ৮ শতাংশ এবং ওষুধে ৬৪ শতাংশ ব্যয় নিজেদেরই বহন করতে হয়। গ্রাম পর্যায়ে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যথাযথ কার্যকর নয়। শহর এলাকায়ও পর্যাপ্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই। এ কারণে রোগীরা চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, দেশে বড় বড় হাসপাতাল হচ্ছে, বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি আসছে, চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, চিকিৎসক ও নার্সরা বিদেশ থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরছেন, তারপরও চিকিৎসার বিষয়ে নানা অভিযোগ আছে। চিকিৎসাসেবার কথা উঠলেই সাধারণভাবে চোখের সামনে হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, যন্ত্রপাতিÑএসবের চিত্র ভেসে ওঠে। নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা, বাজেট বরাদ্দ হয় মূলত এসবের জন্য। চিকিৎসাবিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্রেও তাই দেখা যায়। কিন্তু অধিকাংশ রোগগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ মনে করেন, ঝাড়-ফুঁক, ওঝা, কবিরাজের কাছে রোগীদের যাওয়ার প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। মানুষ সচেতন হলে এবং দেশব্যাপী সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে সব রোগী মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাবে।