November 24, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, March 16th, 2023, 9:31 pm

মানহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে মানহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার। বর্তমানে পরিবহন ও রান্নার কাজে সিলিন্ডারের ব্যবহার দ্রুত বাড়লেও সিলিন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি বাড়ছে না। ফলে দুর্ঘটনায় সম্পদ ও প্রাণহানির ঝুঁকিও বাড়ছে। পরিবহনে এখন সিএনজি (সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস) অনেক জনপ্রিয়। পাশাপাশি ব্যাপক বাড়ছে রান্নার কাজ ও পরিবহনে এলপিজি (তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস) সিলিন্ডারের ব্যবহার। তাতে মানহীন সিলিন্ডারে গাড়িতে ও রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস থেকে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী ২০২২ সালে ৯০টি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। একই বছর গ্যাসলাইন ও গ্যাস সিলিন্ডারের কারণে ৭৬৭টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া বেশ কয়েকটি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস এবং বিস্ফোরক অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মানহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার, পর্যাপ্ত তদারকির অভাব, সিলিন্ডার নিয়মিত পরীক্ষার অভাব, ব্যবহারে অসচেতনতা, রক্ষণাবেক্ষণে দুর্বলতার কারণেই দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে। যানবাহনের প্রায় ৮০ শতাংশ সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা ছাড়াই চলছে। অথচ দুর্ঘটনা এড়াতে মানসম্মত যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা জরুরি। সেক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সূত্র জানায়, দেশে ২০০০ সালের দিকে যানবাহনে গ্যাসের ব্যবহার শুরু হলেও ২০০৫ সালের পর দ্রুত বাড়তে থাকে। গত নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ৫ লাখ ৭ হাজার গাড়ি সিএনজিতে রূপান্তর হয়েছে। আর ২০০৫ সালে রান্নার কাজে এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার শুরু হয়। পাইপলাইনের গ্যাসের ঘাটতির কারণে ২০১৫ সালের পর তা দেশব্যাপী ব্যাপকতা লাভ করে। দেশে এখন প্রায় সাড়ে ৩ কোটির বেশি এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে। বাসাবাড়ি ছাড়াও পরিবহনে ও ক্ষুদ্র শিল্পের জ¦ালানি হিসেবে অনেকেই এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে। আর ওই দুই খাতের বাইরে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাসের সিলিন্ডার রয়েছে। অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংখ্যা ৩০ হাজারের মতো। বর্তমানে দেশে বেড়েই চলেছে সিলিন্ডারজনিত বিস্ফোরণের ঘটনা। তাতে অকালমৃত্যুও বাড়ছে। সূত্র আরো জানায়, এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহারে জীবন সহজ হওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার, অব্যবস্থাপনা ও অবৈধ ব্যবহারের ফলে বিপদ বাড়ছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ী কোনো অনুমোদন ছাড়া নিজেরাই সিলিন্ডার ভরে গ্যাস বিক্রি করছে। এটাকে বলা হয় ক্রস ফিলিং। যা অনিরাপদ। আর এলপিজি কোম্পানিগুলোতে আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা হয়। সিলিন্ডার পরীক্ষা করে বাল্ব ও সেফটি ক্যাপ বসানো হয়। আর ক্রস ফিলিংয়ে হাতের সাহায্যে বাল্ব বসানো হয়। তাই সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। তাছাড়া পরিবহনের সময় সিলিন্ডার কাত করে রাখলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। ট্রাকে তোলার সময় অনেক সময় শ্রমিকরা সিলিন্ডার ছুড়ে দেয়। এতে সিলিন্ডারের নিরাপত্তা বেষ্টনী দুর্বল হয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। মূলত এলপিজি সিলিন্ডারের দুর্ঘটনার বড় কারণ মানহীন রেগুলেটর ও পাইপের ব্যবহার। সিলিন্ডারের বাল্ব কোম্পানিগুলো সরবরাহ করে। রেগুলেটর ও পাইপ গ্রাহক নিজে ক্রয় করে। সেব পণ্যের মান সম্পর্কিত কোনো নীতিমালা নেই। রেগুলেটরের ত্রুটির কারণে গ্যাস লিকেজ হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ২০১৮-১৯ সালে এলপিজি সিলিন্ডারজনিত ১০ ঘটনার মধ্যে ৭টিই ছিল রেগুলেটর-সংক্রান্ত। এদিকে দেশজুড়ে এলপিজি ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটলেও তা তদারকিতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সিলিন্ডার পরীক্ষণে মাত্র একটি পরীক্ষাগার চট্টগ্রামে রয়েছে। আর বেসরকারি কোম্পানিগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সিলিন্ডার নিরীক্ষা করে। প্রতিটি সিলিন্ডারের মেয়াদ ২৫ থেকে ৩০ বছর। ওই মেয়াদকালে তিনবার সিলিন্ডারের নিরাপত্তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। প্রথমে ১০ বছর, এরপর ১৫ বছর, এরপর পাঁচ বছর পর। তাছাড়া প্রতিবার গ্যাস ভরানোর সময় হাইড্রো টেস্ট করা প্রয়োজন। মূলত দুর্ঘটনা ঘটে ব্যবহারে অসচেতনতা ও অসাধু ডিলারদের অসৎ ব্যবসার কারণে। তাছাড়া গ্রাহকরাও সচেতন নন। রান্নার সময় সিলিন্ডারটি চুলার কাছে রাখা হয়। তাতে সিলিন্ডার উত্তপ্ত হয়ে তার গলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। অনেক সময় গ্যাসের সংযোগে ত্রুটি থাকে, যা থেকে চুলা ধরানোর সময় দুর্ঘটনা ঘটে। গাড়ির সিলিন্ডার পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ পরিবহন মালিক তা মানেন না। বর্তমানে দেশে সিএনজি সিলিন্ডার পরীক্ষার জন্য ৮টি ল্যাব আছে। দুটি আরপিজিসিএলের আর ৬টি বেসরকারি কোম্পানির। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নাভানা, সাউদার্ন, ইন্ট্রাকো ইত্যাদি। অন্যদিকে যানবাহনে দুর্ঘটনার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ি মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার। ব্যাপক চাহিদার কারণে দেশে অননুমোদিত সিএনজি কনভার্সন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেখানে অদক্ষ কারিগর দিয়ে সিএনজিচালিত গাড়ির রূপান্তর কার্যক্রম চলায় গাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। নিম্নমানের কম পুরুত্বের সিলিন্ডার দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। নিয়মিত পরীক্ষা না করার কারণেও সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে সিলিন্ডারের ভেতরে অনেক ক্ষয় হয়ে থাকে। ওই ক্ষয় থেকেও ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। সেজন্য নিয়মিত সিলিন্ডারের পরীক্ষা করা উচিত। কিন্তু তা করা হয় না। বর্তমানে দেশে দেড় থেকে দুই লাখ মানহীন সিলিন্ডারযুক্ত গাড়ি রাস্তায় চলছে। গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে সিলিন্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর জানান, সিলিন্ডারের মানহীন সংযোগ থেকে দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে নকল সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়, যা সহজে বিস্ফোরিত হয়। গাড়ি সিএনজিতে চালানোর উপযোগী করার সময় অনেকেই খরচ বাঁচাতে অননুমোদিত ওয়ার্কশপে কাজ করান, নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করেন। ওসব গাড়িতে গ্যাস লিকেজ হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার সময় সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে সিলিন্ডার পরীক্ষণের কাগজ দেখানোর নিয়ম। কিন্তু তা মানা হয় না। বিআরটিএর পরিদর্শকরা অন্যান্য কাগজপত্র দেখতে চাইলেও সিলিন্ডার পরীক্ষার সনদ চান না। অনেকে গাড়ি চালুর আগে সিলিন্ডার সংযোগ পরীক্ষা করে দেখেন না। এ ধরনের অসচেতনতার কারণেও দুর্ঘটনা বাড়ছে। এ বিষয়ে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের একজন জানান, অধিদপ্তরের সীমিত লোকবল দিয়ে সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে সিলিন্ডার নিরীক্ষা করা সম্ভব নয়। বর্তমানে অধিদপ্তরের মাত্র ১০৮ জন জনবল। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে। তাই বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে ঢেলে সাজানো হবে। বিদেশি পরামর্শক দিয়ে জরিপ করিয়ে জনবৃদ্ধি এবং আধুনিক অফিস নির্মাণের প্রস্তাব অনেক আগেই জমা দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবগুলো অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রাশসন মন্ত্রণালয়ে আছে। সরকার সমস্যা সমাধানে কাজ করছে।