মইনুল হোসেন :
সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব না পড়লেও আইন ভাঙ্গায় কিংবা মিথ্যা বলায় একজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী পুলিশের হাতে সাজা ভোগ করতে পারেন এমনটা বিদ্যামন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষকে অবাক করেছে। আমরা তো অসত্যের মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাদের সরকারকে জনগণের আস্থার ওপর নির্ভরই করতে হয় না। ফলে জনমতের কোনো গুরুত্ব না থাকাই স্বাভাবিক। আমরাও এ অসহায় অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ইচ্ছামতো হয়রানি করে চলেছেন। এটিই বাস্তবতা।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যে সঙ্কট মোকাবেলা করছেন; তা দেখে বাংলাদেশের রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিরা হাসাহাসি করতে পারেন। মহামারী কোভিড-১৯ চলাকালে যে বিধি জনগণকে মেনে চলতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন সে সময় নিজে তার অফিসে এক জমায়েত সম্পর্কে অসত্য বলেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্টাফরা এ ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এতে সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু বিধিনিষেধ আরোপে সাধারণ নাগরিকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল যার গুরুতর প্রভাব পড়েছিল জনজীবনে। তারা একত্রিত হতে পারছিলেন না, এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী আপনজনদের শেষ বিদায় জানানোরও সুযোগ পাননি।
আলোচ্য দিনটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন। দিনটি উদযাপনে প্রাধনমন্ত্রীর অফিস চত্বরে ক্ষণিকের জন্য তার অফিস স্টাফরা একত্রিত হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্ত্রী তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। বিষয়টি যখন জানাজানি হয়, তখন তিনি দাবি করেন, আইন ভঙ্গ করার মতো কোনো সমাবেশ হয়নি। এটি সম্ভবত ভুলবশত বরিস জনসন চিন্তা করে থাকবেন, এ জাতীয় তাৎক্ষণিক একত্র হওয়াটা সমাবেশ হতে পারে না।
কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, তিনি অন্যদের সাথে যোগ দেয়াতে তা সমাবেশের রূপ নেয়। ভেতরে অফিসাররা তার জন্মদিন পালন উপলক্ষে যে পানীয় পানের ব্যবস্থা করেন; তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন।
গণমাধ্যমকর্মী এবং পার্লামেন্ট সদস্যরা বিষয়টিকে আইনের বরখেলাপ হিসেবে দেখেন। প্রধানমন্ত্রীর পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অসত্য বলাকে তারা গুরুতর ভ্রান্তি হিসেবে গণ্য করেন। লক্ষ্যণীয়, শুধু বিরোধীদলীয় সদস্যরাই নন, প্রধানমন্ত্রীর নিজের কনজারভেটিভ দলের কিছু সদস্যও বলছেন, তার পদত্যাগ করা উচিত। তাদের বিবেচনায় একজন আইনভঙ্গকারী এবং মিথ্যাবাদী যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তাকে দেশের জনগণের ভাগ্য নির্মাণে বিশ^াস করা যায় না। এ জন্য তাকে পদত্যাগ করতে হবে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম এবং পার্লামেন্ট সদস্যরা এ নিয়ে অত্যন্ত কঠোর মনোভাব পোষণ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একাধিকবার অকুণ্ঠচিত্তে উল্লেখিত ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা সত্তে¡ও তার অস্তিত্ব রক্ষার এ অগ্নিপরীক্ষা বড় বেশি কঠিন ও বিব্রতকর হয়ে উঠছে। আলোচ্য সমাবেশের ব্যাপারটি পুলিশ তদন্ত করে দেখে। একই সাথে এ সিদ্ধান্তে আসে যে, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কোভিড আইনভঙ্গের অপরাধে দায়ী। তাকে ৫০ পাউন্ড জরিমানা করা হলে তিনি ইতস্তত না করে সাথে সাথে পরিশোধ করেন।
আইনভঙ্গের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সাজা দিতে পুলিশের মোটেও ভাবতে হয়নি যে, তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী। পুলিশের ভাবনায় ছিল আইন শুধুই আইন। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাই পুলিশ তাকে আইনভঙ্গকারী হিসেবে দেখতে ইতস্তত বোধ করেনি। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় অন্যরকম ভেবেছিলেন। তার জন্মদিন উপলক্ষে সমাবেশকে আইন অমান্যের মতো সমাবেশ মনে করেননি।
পার্লামেন্ট সদস্যরা এখনো ফুঁসছেন। তারা বিষয়টির ইতি টানতে চাইছেন না। নিজেরাও বিষয়টি তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা নেবেন। বিষয়টির সাথে যে নীতি-নৈতিকতার সম্পৃক্ততা তারা দেখতে পাচ্ছেন তা হলো, যে প্রধানমন্ত্রী আইন ভাঙ্গতে পারেন এবং অসত্য বলতে পারেন, জাতির ভাগ্য নির্ধারণের প্রশ্নে তাকে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি যদিও জাতীয় কোনো বিষয় সম্পর্কে মিথ্যা বলেননি। বড় ধরনের আইনও ভঙ্গ করেননি। রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ ও সততা সম্পর্কে একজন সরকার প্রধানকে কতটা সতর্ক থাকতে হয় তারই একটি মূল্যবান দৃষ্টান্ত এই ঘটনা।
এ দৃষ্টান্ত আমাদের রাজনীতিকদের কাছে এমন এক আজব বার্তা বয়ে আনছে যে, একজন প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীর তুচ্ছ আইন ভঙ্গ করা এবং জাতির জন্য ক্ষতিকর নয় এমন মিথ্যা বলা দেশ শাসনের ব্যাপারে জাতির বিশ^াস হারানোর অশনিসঙ্কেত হিসেবে কাজ করে থাকে। তাদের কথা হলো, তারা অসত্য বলে পার না পেলে এবং আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে না পারলে ক্ষমতাধর হয়ে লাভ কী? কারণ, আমাদের ক্ষমতার রাজনীতি ক্ষমতার জন্য। আর আইন হচ্ছে অন্যদের মেনে চলার বিষয়। আইনের অপব্যবহারও একধরনের আইন, তাও মানতে হবে। অসত্য বলাই রাজনীতি। রাজনৈতিক নেতাদের অসত্য ভাষণ আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য। তাদের ব্যাপারে সত্য বললে যেকোনো বিপদের সম্মুখীন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। ক্ষমতার দাপট এভাবেই দেখাতে হয়!
সত্য চাপা দেয়া আমাদের সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। পাকিস্তানি সেনাদের দখলদারিত্ব থেকে কারা আমাদের মুক্ত করেছিলেন এবং বাংলাদেশ কিভাবে বিপ্লবী দেশে পরিণত হলো এ ইতিহাস স্বীকৃত ভুলের আশ্রয় না নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। আমাদের নেতৃত্ব কোথায় ছিল? প্রকৃত সত্য দিয়ে এটিও ব্যাখ্যা করা যাবে না যে, কেমন করে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটিয়ে আমরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করলাম। আমাদের নির্বাচনগুলো আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দা কুড়াচ্ছে। কিন্তু মিথ্যার জয় হচ্ছে। বৈধতা দাবি করতে সরকারের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। দুর্নীতির ছাড় দেয়া হবে না একথা বারবার শুনছি। কিন্তু দুর্নীতিই সরকারের শক্তি। ব্যাংক ডাকাতি ও মানিলন্ডারিং তো সমানেই চলছে। সরকারি যেসব সুবিধা জনগণের নামে অনুমোদন করা হচ্ছে তা দলীয় লোকেরাই ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছেন। কোনো নিয়মনীতি মানতে হচ্ছে না। অর্থাৎ সব কিছু চলছে অসত্যের ওপর। জনপ্রতিনিধিরা জানেন তারা সত্যিকারের জনপ্রিতিনিধি নন। সরকার সমর্থক না হলেই যে কেউ সন্ত্রাসী। এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী। এখন যারা ক্ষমতায় আছেন তারা স্বাধীনতার সময় কোথায় ছিলেন? জীবন তো সাধারণ মানুষকেই দিতে হয়েছে।
দুর্নীতি হচ্ছে একমাত্র কাজ যেখানে মিথ্যা বলার প্রয়োজন হচ্ছে না। স্বীকৃতভাবে, সর্বত্র দুর্নীতির রাজত্ব চলছে। লুট করতে কোনো অসুবিধা বা বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। এটা সবাই জানেন, কারা কিভাবে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। রাশিয়ার অলিগার্কদের মতো তারাও এ ভেবে এখন উদ্বিগ্ন, যদি তাদের ওপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন বড় বড় দুর্নীতি দেখেও দেখে না। জনগণের প্রতি দায়দায়িত্ব আছে বলে তারা মনে করেন না। সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে কল্যাণমূলক বা কাজের বিনিময়ে দারিদ্র্যবিমোচনের পরিকল্পনার কথা মুখেই বলা হচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ মানুষ যে নিদারুণ কষ্টে আছেন সরকারের তা জানাও সম্ভব নয়। মিথ্যা প্রশংসার লোক তো চারপাশেই আছে। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। নিজের এলাকায় কিছু রাস্তা-ঘাট করাটাই নেতাদের জন্য লাভজনক।
পরিবর্তন আনতে অসত্যের বিপক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব না হলে আমাদের নিয়তি হবে মিথ্যা নিয়ে বেঁচে থেকে অন্যায়-অবিচারের শিকার হওয়া। আর মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে কোনো জাতি মহৎ কিছু অর্জন করতে পারে না।
বড় বড় ইমারত বা সেতু তৈরি করাতো ইট-সুরকির ব্যাপার। মোগল সম্রাটদের মধ্যে আকবরই সম্ভবত সবচেয়ে কম শিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে বড় বড় জ্ঞানী-গুণী পরিবেষ্টিত থাকতেন। তাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন একজন মহান সম্রাট হিসেবে।
আমাদের মন্ত্রীদের আইনকানুন নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না কিংবা অসত্য বলার জন্য সংসদের নিকট জবাবদিহি নিয়েও দুশ্চিন্তা করতে হয় না। কারণ, সংসদ সদস্যরা জানেন তাদের ভিত্তিও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। জনগণকে বিভ্রান্ত করা তাদের প্রতিদিনের রাজনীতি। আইন অথবা আইনের অপব্যবহার সম্পর্কে দেশের রাজনীতিকদের সাধারণ ধারণা হচ্ছে; ওসব বিষয় অন্যদের প্রতিপালন করার জন্য এবং আইন তাদের প্রভাবিত করে না। অসত্য বলাটা সরকারের বিশেষ অধিকার। মিথ্যার জোয়ারে ভাসার কারণে যে একটি দায়িত্বশীল, দুর্নীতিমুক্ত সরকার গঠন করা যাচ্ছে না তা বুঝার চেষ্টা করা হচ্ছে না। মিথ্যার আশ্রয়ই সরকারের ব্যর্থতা।
সরকারের মন্ত্রীদের এবং ক্ষমতাবানদের সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সততা থাকলে বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে আইনের কোনো প্রয়োজন হতো না, গণমাধ্যমেরও সমস্যা থাকত না। সত্যভীতি থেকে রক্ষা পেতেই মিথ্যার দরকার পড়ে। তাই তো নেতারা মিথ্যা নিয়ে গর্ব করে যাচ্ছেন। আর আমরা মিথ্যার রাজত্বের ব্যর্থতা নিয়ে দুর্ভোগে আছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও মুক্তির কথা বলেন না। মিথ্যা বলার বীরত্বই দেশে চলছে।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ