November 14, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, September 5th, 2023, 3:11 pm

মুরাদনগরে ১৭১ টি ছোট-বড় নদী, খাল-বিল দখল, দেখার কেউ নেই!

জেলা প্রতিনিধি, কুমিল্লা (মুরাদনগর) :

মুরাদনগরে ১৭১ টি ছোট-বড় নদী, খাল-বিল দখল। দেখার কেউ নেই। কুমিল্লা জেলা মুরাদনগর উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের ৩০৮টি গ্রামের প্রবাহিত গোমতী নদী, তিতাস নদী, বুড়ি নদী, আর্সি নদী, অদের খাল, কার্জনখাল, মিরের খাল, মরিচা খাল ও জলাশয়ে ছিল ভরপুর। এসব নদী খাল ও জলাশয় ম্যাপে আছে। নদী খাল বিল জলাশয় বিলিন হয়ে গেছে। খালগুলো খণ্ড খণ্ড বাঁধে করে ভরাট করে ফেলে যে যার বাড়ীর সামনে। দেখার কেই নেই? খালও নেই? নেই পানি দেখছে না মুরাদনগরবাসী।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে নদী দখলদারদের সর্বশেষ তালিকা বলছে, এদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নদী, খাল- বিল দখল হয়েছে কুমিল্লা জেলা মুরাদনগর উপজেলায় । সারাদেশে দখলদারের সংখ্যা ৩৯ হাজার আর কুমিল্লায় পৌনে তিন হাজার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপ বলছে- মুরাদনগরে ছোট-বড় মিলে ক,খ ও গ ক্যাটাগরিতে খাল দখল হয়েছে ১৭১টি ।ওই সব নদী খাল বিলে আষাঢ় ও শাওন মাসে নদীনালা -খালবিল পানিতে ভরে যেতো। চৈত্র-বৈশাখ মাসে খাল-বিলের পানি শুকিয়ে গেলেও নদীতে পানি থাকতো। ভারী বর্ষা হলে পানিতে নদীনালা-খালবিল পানিতে তলিয়ে যেতো।  সর্বত্রই ছিল নৌকার বিচরণ। নৌকা ছাড়া মালামাল বাহনের কথা ভাবাই যেতো না। নৌকার ছিল ভিন্ন ভিন্ন নাম ডিঙ্গি, ডোঙা, কোষা, সাম্পান, গয়না, ময়ূরপঙ্খী,পানসী ও ছুঁইওয়ালা। নৌকায় কম খরচে মালামাল আনা নেওয়া হতো । বর্ষাকালে জেলে নৌকা দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো ।  মাঝি মাল্লারা যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যমও ছিল নৌকা।

স্থানীয় মৎস্যজীবীরা এজমালি জলাভূমির ওপর নির্ভর করতেন। ১৯৯০ সালের পর থেকে জলাভূমির ওপর অত্যাচার বাড়তে থাকে । যেই বিলের আকার একশ বিঘার ছিল, লুট হয়ে এখন  তা পঞ্চাশ বিঘাতে এসে ঠেকেছে। খণ্ড খণ্ড বাঁধে দখলে হয়েছে বিলের সাথে থাকা জলাশয়। বিলের পানিতে শাপলা , নৌকা, মাঝি মাল্লা, এখন নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস।

সূত্রে জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জ বাজারের সাথে সংযোগ খাল ছিল ‘মিরের খাল’ ও নগরপাড় মৌজার সাবেক ৩০৪ দাগের একটি খাল। এই দুটি খাল দিয়ে নৌকা চলতো। নারায়নগঞ্জ, নরসংদী, ব্রাক্ষণবাড়িয়া ও ভৈরব থেকে মানুষ নৌকায় এই বাজারে আসা-যাওয়া করতো। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় খাল দখল করে বাসা-বাড়ি, দোকান পাট নির্মাণ করে রেখেছেন। যার ফলে বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় বাজার ও রাস্তাঘাট। সৃষ্টি হয় জলজট।

একসময় গোমতীর শাখা ছিল ‘বুড়ি নদী’। এই নদী নিয়ে স্থানীয়দের রয়েছে অনেক সুখ ও দুঃখের গল্প। বুড়ি নদী গুঞ্জর গ্রাম থেকে শুরু হয়ে দেবিদ্বার উপজেলা রসুলপুর গ্রাম হয়ে মুরাদনগর উপজেলার টনকী গ্রাম ও আন্দিকোট ইউনিয়ন হয়ে নবীনগর লঞ্চঘাট সংলগ্ন তিতাসে গিয়ে পতিত হয়েছে। বিশাল এই নদীটি দখল -দুষণে প্রায় মৃত।

‘আর্সি নদী’ , এটি বুড়ি নদীর শাখা থেকে যার উৎপত্তি । নদীটি দেবিদ্বার উপজেলার বড়শালঘর গ্রাম থেকে মুরাদনগরের মেটঘর গ্রাম দিয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা তিতাস নদীতে গিয়ে মিশেছে।

কৃষকরা জানান, আর্সি নদীর মুরাদনগরের বিভিন্ন আন্দিকোট গুচ্ছ গ্রামের পাশে ২টি বাঁধ দিয়ে দখল হয়ে গেছে। যার ফলে তারা সময় মতো জমিনে পানি দিতে ও সরাতে পারেন না। নদীটির বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ দেওয়ার ফলে এখন আর নৌকা চলে না।

উপজেলার জেলেরা বলেন, খাল-বিল, নদী নালা উদ্ধারে সরকারের জোরালো ভূমিকা দরকার। এগুলো কোন ব্যক্তির মালিকানা নয়, প্রাকৃতিক সম্পদ। খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় আমরা কোথায় জাল ফেলতে পারি না। জেলেরা যেন প্রাকৃতিক জলাভূমিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন এই ব্যবস্থা করতে হবে।

উপজেলার স্থানীয় কৃষক মিজান মিয়া বলেন- আলীর চর গ্রামে দুটি খাল তারের শরীফ ও মরহুমের খাল দখল হয়ে গেছে এগুলো খনন করা প্রয়োজন।
খামার গ্রাম থেকে কাউছার আলম বলেন, বাঙ্গরা পূর্ব ইউনিয়নের খামার গ্রাম পশ্চিম পাড়ার খালটি দখলে বন্ধ হয়ে গেছে।
মিজান সরকার, মিজা শহিদুল হাসান বলেন, রগুরামপুর গ্রাম যাত্রাপুর গ্রামের পূবপাড়া হয়ে যাত্রাপুর পশ্চিম পাড়া মিজাবাড়ীর হয়ে কামাল্লা বিলে যায় খালটি দখল করে রেখেছেন প্রভাবশালীরা।

স্থানীয় কামাল সরকার বলেন, মধ্যনগর মসজিদের সামনের খালসহ এলকার প্রায় সব খাল ভরাট করা হয়ে গেছে। যার কারণে জায়গায় জায়গায় পানি আটকিয়ে থাকে । কৃষি জমি চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। শ্রীকাইল ইউনিয়নের পিঁপড়িয়া মৌজার বিএস ৮২৫ দাগের পিঁপড়িয়া থেকে স্বল্পা খালটিও দখলে চলে গেছে ,বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষির জরুরি প্রয়োজনে খালটি পুনঃখনন করতে আইনি সহায়তা চেয়েছেন এলাকাবাসী।

স্থানীয় হেলাল উদ্দিন সরকার জানান, পাহাড়পুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডেও ভিটি পাঁচপুকুরিয়া গ্রামের মাদ্রাসা খাল দখল হয়ে গেছে।
স্থানীয় আবু মুছা জানান, ১৫নং নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়নের মিরের খাল দখল হয়েছে। এই খাল দখলের ফলে জায়গায় জায়গায় পানি জমে থাকে। এতে রাস্তাঘাট খুব অল্পসময়ে নষ্ট হয়ে যায়।

স্থানীয় গিয়াস উদ্দিন বলেন, মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পেছনে বিশাল বড় খাল ছিলো। এই খাল দিয়ে নৌকা যোগে রামচন্দ্রপুর বাজার , নবীনগর উপজেলা হোমনা উপজেলার সাথে জড়িত ছিলে। সেই খালটি সম্পূন ভরাট হয়ে যায়।

কৃষি ও পরিবেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ উজ্জল বলেন, সরকারি খাল-বিল দখল করে যারা অবৈধ স্থাপনা তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে খালগুলো দখল মুক্ত করা প্রয়োজন। ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলো নজরদারি বাড়িয়ে কাজ করলে কৃষি ও পরিবেশ রক্ষায় খাল-বিল এতো দখল হতো না।

মুরাদনগর উপজেলা কৃষি অফিসার পাভেল খান পাপ্পু বলেন, খাল দখল নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এর সংখ্যা যাই হোক-কোন এলাকায় একটি খালও যদি ভরাট হয়ে যায় তাহলে পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্থ হবে, আর পানির প্রবাহ না থাকলে কৃষি জমি কমে যাবে। এছাড়া খাল দখলের কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখতে দখল হওয়া খাল নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে আমরা এক হয়ে সহযোগিতা করব।

মুরাদনগর উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আলাউদ্দীন ভূইয়া জনী বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। কোথায় কী কারণে খাল দখল হয়েছে তা আমার জানা নেই। তাই কোন মন্তব্য করতে পারছি না। খোজখবর নিচ্ছি।সরকারী নদী খাল দখল করার কোন সুযোগ নেই? ###