নিজস্ব প্রতিবেদক:
মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে তিতাসের গ্যাসলাইন। পুরোনো লাইনের পাশাপাশি অবৈধ সংযোগ, নিম্নমানের পাইপের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে বিপৎসঙ্কুল হয়ে পড়েছে তিতাসের গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী গত ৫ বছরে তিতাসের আওতাধীন এলাকায় গ্যাস পাইপলাইনজনিত ১৪ দুর্ঘটনায় ৫৮ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। তিতাস গ্যাস সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রাকৃতিক গ্যাসের অন্যতম উপাদান মিথেন। কক্ষে আবদ্ধ গ্যাস বৈদ্যুতিক স্পার্ক বা আগুনের সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরিত হয়। বাসাবাড়ির লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভবনের ভেতরে গ্যাস জমা হতে পারে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের পাথরঘাটার একটি বহুতল ভবনের ভেতরের পাইপলাইনের মরিচা ধরা অংশ লিকেজ হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। বিতরণ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পয়ঃনিষ্কাশন লাইনের মধ্য দিয়ে গ্যাস বদ্ধ কোনো স্থানে জমতে পারে। ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই ঢাকার মগবাজার মোড়ে একটি খাবারের বেসিনের পাইপ ফুটপাতের ড্রেনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ড্রেনে থাকা পাইপলাইন লিকেজ হয়ে গ্যাস বেসিনের পাইপ দিয়ে বদ্ধ ঘরে জমা হয়। লাইটের সুইচ দেওয়ার সময় আগুনের স্পর্শে বিস্ফোরণ ঘটে। তাছাড়া গ্যাসের চুলা ঠিকমতো বন্ধ না করলে বা ত্রুটিপূর্ণ সুইচ থেকে বদ্ধ ঘরে গ্যাস জমে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর এবং কেরানীগঞ্জের ১ হাজার ৬৮২.৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নিরীক্ষা করে প্রাথমিকভাবে ৯ হাজার ৯২৬টি মিথেনের উৎস চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ৪৫৯টি স্থান লিকেজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরে এসব লিকেজ সংস্কার করা হয়। গ্যাস বিতরণের পাইপগুলো মাটির নিচে দেয়ার সময় মরিচা নিরোধক কালো প¬াস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হয়। আবরণ ছাড়া মাটির নিচে পাইপ স্থাপন করলে মরিচা ধরে লিকেজ হতে পারে। অনেক সময় পাইপের মানের ওপরও লিকেজ হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে। তিতাস মূলত চীন থেকে পাইপ আনে। চীনের পাইপ অন্য দেশের চেয়ে সস্তা। অনেক ক্ষেত্রেই এর মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তারপর কোরিয়া থেকে আমদানির চিন্তা করা হলেও দাম বেশি বলে বিষয়টি আর এগোয়নি। বেশিরভাগ পাইপই মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কারণে লিকেজ হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন সেবা সংস্থার সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ির কারণেও তিতাসের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকা বিভাগে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত তিতাস গ্যাসের ১২ হাজার ২৫৩ কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় আছে ৭ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন। এর ৬০ শতাংশ অতি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে ২০ থেকে ৪০ বছরের পুরোনো বিতরণ পাইপলাইনও আছে। মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লাইন পাল্টানো হলেও ধারাবাহিক রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম তেমন একটা নেই। ১৯৬৭-৬৮ সালে ডেমরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ ইঞ্চি এবং ডেমরা থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ১৪ ইঞ্চি ও ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়। এরপর সেখান থেকে ২ ইঞ্চি থেকে ৬ ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করে গ্রাহকদের বাসাবাড়ি ও কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। ৮০ এবং ৯০ দশকে ঢাকা ও এর আশপাশে পাইপলাইনের ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়। ২০০০ সালের পর থেকে লাইনের সম্প্রসারণ কমে যায়। বর্তমানে তিতাসের বিতরণ নেটওয়ার্কের অধিকাংশ পাইপলাইনের মেয়াদ প্রায় ফুরিয়ে গেছে। সূত্র আরো জানায়, রাজধানীর আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতের ভবনগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় এদিকে সরকারের নজরও কম। ২০১৫ সালের পর থেকে নতুন পাইপলাইন স্থাপন বন্ধ। বিতরণ এলাকার অধিকাংশ পাইপলাইন ২০ থেকে ৪০ বছরের পুরনো হলেও প্রতি বছর মাত্র কয়েক কিলোমিটার লাইন প্রতিস্থাপন করা হয়। আর ওসব সংস্কার কার্যক্রমের অধিকাংশই হয় তদবিরকারী ও প্রভাবশালীদের এলাকায়। বিতরণ পাইপলাইন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। কারণ এ খাতে নামমাত্র অর্থ খরচ করে তিতাস, যেখানে কোম্পানিটি গ্যাস বিক্রি করে প্রতি বছর কয়েকশ কোটি টাকা লাভ করে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তিতাসের নিট লাভ ছিল ৩১৮ কোটি টাকা। ওই সময়ে কোম্পানিটি মাত্র ৮২ দশমিক ৩১ কিলোমিটার লাইন সংস্কার ও প্রতিস্থাপন করেছে। তাছাড়া অবৈধ সংযোগের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরো বেড়েছে। অভিযান চালিয়ে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও এর সংখ্যা কমছে না। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৮৮টি অভিযানে ৩৪০ কিলোমিটার অবৈধ লাইন উচ্ছেদ এবং ২ লাখ ৭৪ হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ঢাকার বাইরে নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর ও কিশোরগঞ্জে তিতাসের পাইপলাইন আছে। এর মধ্যে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নরসিংদীতে অবৈধ গ্যাস সংযোগের সংখ্যা বেশি। তিতাসের আওতাধীন এলাকায় এখনো শতাধিক কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন রয়েছে। অভিযোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব তিতাসের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব অবৈধ সংযোগের বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। সংযোগপ্রতি মাসিক বিলও তোলা হয় এসব এলাকায়। তবে তিতাস কর্তৃপক্ষ দাবি করে, প্রায়ই অভিযান চালিয়ে অবৈধ সংযোগ ও পাইপলাইন স্থাপন নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কারণ এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে স্থানীয় সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও প্রভাবশালীরা জড়িত। এদিকে গ্যাসলাইনের কোথাও লিকেজ হলে তা জানানোর পরও তিতাসের পক্ষ থেকে প্রায় ক্ষেত্রেই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে গ্যাস পাইপলাইনে এক ধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়, যাতে কোথাও লিকেজ হলে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং সাবধান হওয়া যায়। এখন সম্ভবত এ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে কোথাও পাইপলাইনের ক্ষতি হলেও সহজে বোঝা যাচ্ছে না। পাশাপাশি গ্যাস দুর্ঘটনার জন্য গ্রাহকদের অসচেতনতাও দায়ি। রান্নার পর চুলা নেভানো হয় না অনেক সময়। বাসাবাড়ির গ্যাসের ফিটিংস অদক্ষ মেকানিক দিয়ে করা হয়। অবৈধ লাইন ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ব্যবহার করা হয়। এসব কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে এ বিষয়ে তিতাসের এমডি প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ জানান, তিতাসের বিতরণ লাইনের একটি বড় অংশ বেশ পুরোনো। দীর্ঘদিন ধরে নতুন লাইন বসানোর কার্যক্রম নেই। কোথাও ত্রুটি পেলে সেই লাইন পাল্টিয়ে দেয়া হয়। তিনি অভিযোগ করেন, রাস্তার খোঁড়াখুঁড়িতে প্রায়ই লাইনের ক্ষতি হয়। আর অবৈধ সংযোগের বিষয়ে তিতাস কঠোর অবস্থানে রয়েছে। নিয়মিত অভিযান চলছে। অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি হচ্ছে। পুরোনো লাইন প্রতিস্থাপনে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা জ¦ালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ