নিজস্ব প্রতিবেদক:
ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ও ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে আগামী ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকবে। বুধবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. ইফতেখার হোসেন এ তথ্য জানান। তিনি জানান, চলতি বছর ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে আগামী ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রে ইলিশসহ সব ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সময় ইলিশকে স্বাচ্ছন্দ্যে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতেই সরকার দেশের সব নদ-নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ সপদ উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় সম্পদ টাস্কফোর্স কমিটির সভায় মত প্রকাশের সময় মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ইলিশ মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও অভিযান পরিচালনা করা হয় মূলত মৎস্যজীবীদের স্বার্থেই। এটি জাতীয় স্বার্থ। যারা এটি ধ্বংস করতে চাইবে, তাদের বিষয়ে কোন প্রকার বিবেচনা বা অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই।
এক্ষেত্রে যতোটা কঠিন হওয়া প্রয়োজন সরকার ততোটাই কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী মহোদয়। তিনি অসাধু মৎস্য শিকারীদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, নির্ধারিত সময়ে ইলিশ আহরণ রোধ করতে কঠিন থেকে কঠিনতর পদক্ষেপ নিতে সরকার কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করবে না। কাউকে এ বিষয়ে এক চুল পরিমাণ ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই।
তিনি বলেন, কোনভাবেই মৎস্য খাতকে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা, নজরদারি ও পৃষ্ঠপোষকতায় মাছে-ভাতে বাঙালির বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ও কৃষি বিভাগ কাজ করছে।
ইলিশের সঠিক প্রজনন-কালঃ ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের একটি টিম চাঁদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের ইলিশ মাছ নিয়ে গবেষণা করে আসছে। তারা এই মাছের প্রজনন ঋতু সঠিকভাবে নির্ধারণের চেষ্টা করছে। আর প্রজনন ঋতু নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্ত্রী মাছের জিএসআই (এড়হধফড় ঝড়সধঃরপ ওহফবী) পরিমাপপদ্ধতি ব্যবহার করছে তারা। জিএসআই হলো মাছের ডিমের ওজন ও দেহের ওজনের অনুপাতের শতকরা হার। সাধারণত প্রজনন ঋতুতে ডিমের আকার বড় হতে থাকে বলে জিএসআই বাড়তে থাকে এবং ভরা প্রজনন মৌসুমে গিয়ে তা সর্বোচ্চ হয়। প্রজনন ঋতুতে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়ে বিগত পাঁচ বছরের জিএসআইর পরিমাপ থেকে দেখা গেছে যে বাংলাদেশে ইলিশ সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত প্রজনন করে। সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে জিএসআই ১০-১১ থেকে বাড়তে বাড়তে অক্টোবরের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকে এসে সর্বোচ্চ ১৫-১৭ পর্যন্ত পৌঁছায় এবং নভেম্বরে এসে তা হঠাৎ করে কমে যায়। ১৫-১৭ জিএসআই ইলিশের ভরা প্রজনন মৌসুম নির্দেশ করে।
তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য অনেক মাছ, কাঁকড়া কিংবা চিংড়ির মতো ইলিশ মাছও প্রজননের ক্ষেত্রে চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে। অর্থাৎ এই মাছ ভরা পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় প্রজনন করে। মাছের প্রজননের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো তাপমাত্রা। প্রজননের জন্য চন্দ্রনির্ভর আবর্তনের ওপর নির্ভরশীল মাছ সারা বছরের মধ্যে তার পছন্দনীয় তাপমাত্রা যে মৌসুমে পাওয়া যায়, সেই মৌসুমের পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যায় প্রজনন করে। ইলিশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।
গবেষণা টিমের মতে, ইলিশ শুধু পূর্ণিমাতেই প্রজনন করবেÑএ ধারণা ভুল। চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে এমন অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেখে জানা যায় যে পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যা যেকোনো সময়েই এসব মাছ প্রজনন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত ওই নির্দিষ্ট পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যার দিনসহ আগে ও পরের কয়েক দিন ধরে মাছ সবচেয়ে বেশি প্রজনন করতে দেখা যায়। কিন্তু ইলিশ মাছের প্রজনন ঋতু নির্ধারণ এবং ভরা প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে এসব বিষয় বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ২০১০ সালের অক্টোবরের ১৬ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল, আর পূর্ণিমা ছিল ২৩ অক্টোবর। পূর্ণিমার দুই দিন পর থেকে কি মাছের প্রজনন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? পরবর্তী দুই বছর ইলিশ আহরণ নিষেধের সময় ১০ দিন করে এগিয়ে আনা হলো। ২০১১ সালের অক্টোবরের ৬ থেকে ১৬ এবং ২০১২ সালে সেপ্টেম্বরের ২৫ থেকে অক্টোবরের ৫ তারিখ পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে পূর্ণিমা ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর।
তারা আরও জানায়, ২০১০ সালে যে ইলিশ ২৩ অক্টোবর প্রজনন করেছিল, ২০১২ সালে এসে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে সেই ইলিশ প্রায় এক মাস আগে প্রজনন করবে তা অসম্ভব। ২০১৩ সালে এসে ১৩ থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হলো এবং এ সময় পূর্ণিমা ছিল ১৯ অক্টোবর। ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আবার আগের নিয়মে ১০ দিন করে এগিয়ে আনতে আনতে এ বছর ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের সময় ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর। তাহলে কি ধরে নেয়া যায় যে, ইলিশের ক্ষেত্রে প্রতি তিন বছর পরপর প্রজননের চন্দ্রনির্ভর আবর্তন পরিবর্তন হয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। জৈবিকভাবে সেটি এত দ্রুত ঘটা কি সম্ভব? জলবায়ু পরিবর্তন, হাইড্রোলজিক সাইকেলের ব্যাপক পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে ইলিশের প্রজনন ঋতু এক মাস এগিয়ে বা পিছিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সেটি তিন বছরের মতো এত কম সময়ে সম্ভব নয়।
প্রজনন কালে ইলিশ আহরণ বন্ধের সুফলঃ বিগত কয়েক বছর ধরে সরকার প্রজনন কালে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় ইলিশের উৎপাদন বহুগুণে বেড়েছে বলে মনে করেন ইলিশ গবেষক নিয়ামুল নাসের।
এ আদেশ অমান্য করলে কারাদ-, অর্থদ- বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। এ কারণে এখন আর আগের মতো বছরব্যাপী অবাধে ইলিশ আহরণের সুযোগ নেই।
ইলিশের উৎপাদন বাড়ার কারণ হিসেবে নিয়ামুল নাসের জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নদীর পানির গুনাগণ ও প্রবাহ ইলিশের প্রজননের জন্য এখনও অনুকূলে আছে। এ কারণে ডিমওয়ালা মা ইলিশ সাগর থেকে ¯্রােতযুক্ত মিঠাপানির নদীতে এসে ডিম ছাড়ে।
তাঁর মতে, ইলিশ মাছ জুলাই মাসের দিকে সমুদ্র থেকে নদীতে আসতে শুরু করে। এ সময় তারা পদ্মার দিকেই আসে। কারণ পদ্মার পানির স্তর ও গভীরতা অন্য নদীর চাইতে তখন বেশি। এ কারণে এত বেশি মাছ পাওয়া যায়।
এছাড়া সামুদ্রিক নিম্নচাপ এবং সাইক্লোনের একটা প্রভাব থাকার কারণেও ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা ওই সময়টায় জেলেরা ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে যেতে পারে না। এই সময়ে ইলিশ বড় হতে সময় পায়।
তবে নদীর প্রবাহ ও গভীরতা দিন দিন কমে আসার কারণে এই ইলিশের আহরণ টেকসই থাকবে কিনা সেটা নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পলির কারণে নদীর তলদেশ প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। এভাবে পলি জমতে জমতে যদি নদীর গভীরতা ও পানি প্রবাহ কমে যায় তাহলে ইলিশ আর নদীতে আসতে চাইবে না বলে আশঙ্কা ইলিশ গবেষকদের।
এছাড়া কীটনাশক ও শিল্প কারখানার কেমিকেল নদীতে ফেলার কারণে যে দূষণ হচ্ছে সেটাও মাছের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে বলে জানান নিয়ামুল নাসের।
ইলিশের উৎপাদন টেকসই রাখতে নদীর পাশাপাশি সমুদ্রেও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।
তাঁর মতে, সমুদ্রের কোন অংশে ইলিশ বিচরণ করে সেটা গবেষণার মাধ্যমে বের করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যে জাটকাগুলোকে আমরা নদী থেকে সমুদ্রে পাঠাচ্ছি, সেটা যেন সমুদ্রে টিকে থাকতে পারে এজন্য ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে নো ট্রলার জোন করতে হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ইলিশ মাছকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মেধা-স্বত্ব কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যানুযায়ী দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। এ ছাড়া পৃথিবীর মোট ইলিশের প্রায় ৬০ ভাগ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে।
এই বিপুল চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো। আর সেজন্য ইলিশের জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজননসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে আসছে বাংলাদেশ সরকার। সারাদেশে ২২ দিনের এই ইলিশ আহরণ নিষেধাজ্ঞা আগের মতই সুফল বয়ে নিয়ে আসবে বলে মনে করেন গবেষকরা।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ