April 27, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, December 19th, 2022, 7:45 pm

যেমন আছে বোস্তামীর কচ্ছপেরা

চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারের পুকুরে পৃথিবীর বিরল প্রজাতির কয়েকটি কাছিম বা কচ্ছপের বসবাস। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অত্যন্ত বিরল এবং বিপন্নপ্রায় এই প্রাণী বোস্তামীর কাছিম বা বোস্তামীর কচ্ছপ নামে পরিচিত হলেও চট্টগ্রামের লোকজন তাদের ডাকে ‘গজারী-মাজারী’ নামে।

বৈজ্ঞানিকভাবে এদের কালো নরম খোলের কচ্ছপ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম হলো- অ্যাসপিডারেটিস নিগ্রিকান।

বায়েজিদ বোস্তামী মাজারের মোতোয়ালি অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম বলেন, পৃথিবীতে এই প্রজাতির কাছিম এখন শুধু এখানেই টিকে আছে। কয়েকশ’ বছর ধরে এগুলো মাজারের পুকুরে বসবাস করে আসছে। অতীতে এদের পরিচর্যায় তেমন নজর দেয়া না হলেও কয়েক বছর ধরে যথাযথভাবেই দেখাশোনা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ কর্তৃক ২০০২ সালে বোস্তামীর কচ্ছপকে চরমভাবে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

১৯৯৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) অন্যতম বিপন্নপ্রায় প্রাণীর তালিকায় বোস্তামী কাছিমের নাম উঠে আসে।

তবে মাজারের ভক্তকূল ও স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি রয়েছে ইসলাম ধর্মের সাধক পুরুষ হযরত বায়েজিদ বোস্তামী এই অঞ্চলে ভ্রমণকালে দুষ্ট জ্বীন এবং পাপিষ্ঠ আত্মার পদচারণা ছিল এলাকাটিতে। এসব দুষ্ট আত্মাকে শাস্তিস্বরূপ কচ্ছপে পরিণত করেন এবং আজীবন পুকুরে বসবাসের দণ্ডাদেশ দেন তিনি। সে থেকে যুগ যুগ ধরে নগরীর অক্সিজেন এলাকায় বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার সংলগ্ন পুকুরে এদের অবস্থান।

প্রাণিবিজ্ঞানী অ্যান্ডারসন ১৮৭৫ সালে সর্বপ্রথম ভারতের জাদুঘরে রক্ষিত দুটি নমুনা থেকে বোস্তামীর কচ্ছপের প্রজাতিটির সন্ধান পান। রক্ষিত নমুনা দুটি ছিল চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার পুকুর থেকে সংগৃহীত।

পরিবেশবাদী সংগঠন ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের ফ্যাসিলিটি ম্যানেজার ফাহিম জাহান বলেন, বোস্তামী কাছিম পৃথিবীতে একটি চরম সংকটাপন্ন প্রাণী। তাই তাদের বংশ বৃদ্ধিতে আমরা গত তিন বছর ধরে মাজার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি। চলতি বছর ৭৫২টি ডিম থেকে ২০৫টি বাচ্চা হয়েছে। পুকুরের গজার মাছ খেয়ে ফেলে বলে আলাদা প্রজননকেন্দ্রে এগুলোকে লালনপালন করা হচ্ছে। বড় হলে পুকুরে ছাড়া হবে।

এদিকে, এই কচ্ছপের ওপর ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল ডকুমেন্টারি তৈরি করে ২০০৭ সালে। বিশেষ প্রজাতির এই কচ্ছপগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। মার্চের প্রথম থেকে মে পর্যন্ত বোস্তামী কাছিমের ডিম পাড়ার মৌসুম। ডিম দেয়ার ৮০ থেকে ৯০ দিন পর এর বাচ্চা ফোটে। এই কচ্ছপগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য- আকারে এই কচ্ছপ অনেক বড় হয় এবং ওজনও বেশি। কালের সাক্ষী হয়ে এসব প্রাণীর শত বছর বেঁচে থাকার অপূর্ব ক্ষমতা রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ জানান, ২০০৪ সালে একবার পুকুরটিতে বিষ দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। তখন পুকুরের পানি সেচে ফেলার সময় প্রায় ৫০০ কাছিম পাওয়া যায়।

 

তিনি আরও জানান, এসব কাছিম প্রতি বছর গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ ডিম দেয়। কিন্তু বাচ্চা হতো ১৫ থেকে ২০টি। বাচ্চা ফুটলেও সেগুলোর বড় একটি অংশ পুকুরে থাকা গজার ও মাগুর মাছে খেয়ে ফেলত। এ জন্য কাছিমের সংখ্যা না বেড়ে উল্টো কমে যাচ্ছিল।

এ জন্য বোস্তামী কচ্ছপের বংশবৃদ্ধিতে আমরা গত তিন বছর ধরে মাজার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি। মাজারের পাশে একটি কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্র তৈরি করে দিয়েছি। একটি এনজিও বাচ্চা ফোটানোর দায়িত্বে আছে। সঠিক পরিচর্যার কারণে এখন বোস্তামী কাছিমের সংখ্যা বাড়ছে।

সূত্রমতে, ১৯৩১ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী ম্যালকম স্মিথ তার ফনা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ভারতবর্ষে ‘নিলসোনিয়া নিগরিকেন টার্টেল’ একমাত্র বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজারে পাওয়া যায়।

স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, হযরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামী (র.) ইরান থেকে চট্টগ্রামে আসার সময় এ কাছিমগুলো নিয়ে আসেন।

প্রাণী বিজ্ঞানীদের ধারণা, বোস্তামী কাছিম বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশ অঞ্চলের প্রাণী।

২০০৯ সালে ক্যারিনামের নির্বাহী পরিচালক এস এম এ রশিদ এবং অস্ট্রীয় বিজ্ঞানী পিটার গ্রাসবাগ বাংলাদেশে মিঠা পানির কাছিমের ব্যবসা নিয়ে একটি গবেষণা করছিলেন। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল বাজারে বেশ ভিন্ন ধরনের কাছিম দেখতে পান। তাৎক্ষণিকভাবে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য কাছিমের শরীর থেকে কিছু কোষ সংগ্রহ করেন তারা। পরে ২০১০ সালে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানিকছড়িতে জেলেদের বড়শিতে ধরা পড়া একটা কাছিম দেখতে পান। বোস্তামী কাছিমের মতো মনে হওয়ায় সেটিরও কোষ ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য সংগ্রহ করা হয়। ২০১১-১২ সালে এ প্রজাতির কাছিম মুহুরী নদী ও নেত্রকোণার একটি জলাশয় থেকেও সংগ্রহ করে গবেষক দল।

ইতোমধ্যে ড. গ্রাসবার্গ জানান, জার্মানির ড্রেসডেন অবস্থিত মিউজিয়াম অব জুওলজিতে কয়েক প্রজাতির কাছিম শনাক্ত করার জন্য গবেষণা চলছে। সেখানে সংগ্রহ করা কোষের নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে জানা গেল দুটি টিস্যুর নমুনা, দুটিরই নিলসোনিয়া নিগ্রিক্যান্স বা বোস্তামী কাছিমের।

আরও জানা গেল, এ প্রজাতির বাহ্যিক রঙের কয়েক প্রকার রয়েছে, যা বয়স বা স্থানের কারণে হতে পারে।

এ ব্যাপারে গবেষক শাহারিয়ার সিজার বলেন, ২০১২ সালে অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানি পিটার প্রাসচাগের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয় ভার্টিব্রেট জিউলজি জার্নালে। তিনি উপমহাদেশের কচ্ছপ এবং কাছিমের ওপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

উপমহাদেশের কাছিমের ডাটা এবং জিনগত গবেষণা করে জানান, বায়োজিদ বোস্তামির কাছিম খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি এবং মৌলভীবাজারে পাওয়া গেছে। এছাড়া সিলেট এবং আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের বসবাস রয়েছে।

এই জাতের কাছিম প্রজননের জন্য নিজেরা কাজ করছেন জানিয়ে শাহারিয়ার সিজার বলেন, এই কাছিমের বড় একটি অংশ চট্টগ্রামের বায়োজিদ বোস্তামির মাজারে টিকে আছে।

২০০৪ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, তখন পর্যন্ত এর সংখ্যা ছিল ৪০৮টি। এরা প্রজনন মৌসুমে পানি থেকে ওপরে উঠে মাটিতে গর্ত করে ডিম পারে এবং মাটি দিয়ে সে গর্ত ঢেকে দেয়। এটাই তাদের স্বাভাবিক প্রজননের নিয়ম। কিন্তু পুকুরের দূষিত পানি ও পুকুর পাড়ের মাটি শক্ত হওয়ায় ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে না। এ ছাড়া ডিম দেওয়ার জন্য নিরাপদ জায়গা না থাকা এবং কুকুর, বিড়াল ও কাকসহ বিভিন্ন প্রাণী এদের ডিম খেয়ে ফেলাসহ নানা সমস্যায় এদের প্রজনন বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

আইইউসিএন এর হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে মোট ২৬০ জাতের কাছিম রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৩০ প্রজাতির, যার ছয়টি ছাড়া বাকি সবগুলোর নাম বিপন্নপ্রায় প্রাণীদের তালিকায় উঠেছে। শত বছরের ওপরে আয়ু নিয়ে জন্ম নেয়া বোস্তামী কাছিমের যে কটি জাত দেশের বিভিন্ন নদী-জলাশয়ে পাওয়া গেছে, তার দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার। তবে বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজারের কাছিমগুলোর দৈর্ঘ্য ৯০ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার পর্যন্ত। খয়েরি ও কালচে রঙের এ প্রাণী মূলত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় জীবন ধারণ করতে পারে।

বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার প্রাঙ্গণে, মাজারের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়ক কমিটির লোকদের দ্বারা এদের প্রতিপালন করা হয়। বর্তমানে মাজার প্রাঙ্গণ সংলগ্ন দীঘিতে দুইশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ কচ্ছপের আবাস রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রজনন মৌসুমে মাজারের মূল পাহাড়ের পেছনে এদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে এদের ডিম পাড়ার ব্যবস্থা করা হয়।

এদের গড় বয়স ১শ’ বছরের চেয়েও বেশি। প্রতিদিন মাজারে আগত শত শত নারী পুরুষ মানতের উদ্দেশ্যে এসব কচ্ছপকে পাউরুটি, কলা ও বিস্কুট খাওয়ায়।

এই প্রজাতির কচ্ছপ এতই দুর্লভ ১৯১৪ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী এন এন্ডেলের ও অন্য প্রাণী বিজ্ঞানী এম শাস্ত্রী এক গবেষণায় উল্লেখ করেন বোস্তামীর কচ্ছপ বর্তমানে শুধু চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার সংলগ্ন পুকুরে টিকে আছে। পৃথিবীর কোথাও এই প্রজাতির কচ্ছপ আর দেখা যায় না। ২০০২ সালে পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) কর্তৃক বোস্তামী কচ্ছপকে চরমভাবে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়। তাই এই কচ্ছপের ওপর ২০০৭ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল এক ডকুমেন্টারি তৈরি করে নিয়ে যায়। এগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য- আকারে এই কচ্ছপ অনেক বড় হয় এবং ওজনও নাকি বেশি হয়। কালের সাক্ষী হয়ে শত শত বছর এদের বেঁচে থাকার অপূর্ব ক্ষমতা আছে।

প্রচলিত আছে বায়েজিদ বোস্তামী নিজে এসব কচ্ছপ চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছিলেন।আবার কেউ কেউ বলেন বায়েজিদ বোস্তামী (রহঃ) দুষ্ট জিনদের কচ্ছপ বানিয়ে বন্দি করে রেখেছেন।

দুঃখজনক খবর জীব বৈচিত্রের নিদর্শন নিরীহ এই কচ্ছপগুলোকে ২০০৪ সালের মে মাসে একবার পুকুরে বিষ ঢেলে এদের বংশ নির্বংশ করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু জাতীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের ত্বরিত পদক্ষেপে কোন মতে রক্ষা পেয়ে যায় কচ্ছপগুলো।

২০০২ সালে পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) কর্তৃক বোস্তামী কাছিমকে চরমভাবে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

—-ইউএনবি