May 3, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, October 7th, 2022, 8:37 pm

রংপুরের দেড় বছর ধরে বন্ধ সেতুর নির্মাণকাজ, হাজারো মানুষের ভোগান্তি

আব্দুর রহমান মিন্টু , রংপুর :

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই নায়রা গ্রামে দুই কিলোমিটার পাকা সড়কসহ একটি সেতু এবং একটি কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং কাজের চেয়ে বেশি বিল উত্তোলন করে প্রায় দেড় বছরে ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে করে কাচু মহেষওয়ালা মোড়-নায়রা সড়কের আট গ্রামের মানুষ এখন ভোগান্তিতে পড়েছে।
উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রভাতী প্রকল্পের আওতায় এলজিইডির অধীনে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে উপজেলার সারাই ইউনিয়নের কাচু মহিষওয়ালার মোড় বাজার থেকে নায়রা প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পাকা সড়ক এবং মানাস খালের ওপর ১৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু ও একটি কালভার্ট নির্মাণে প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয় ২ কোটি ৪৮ লাখ ১৫ হাজার ১৯১ টাকা। তবে টেন্ডারে তা কমিয়ে ২ কোটি ২১ লাখ ৯১ হাজার ৪৬৩ টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালের ৩ এপ্রিলে নির্মাণকাজের কার্যাদেশ পায় কে.জেড.এইচ.সি (জেভি) নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
২০২১ সালের ৩ এপ্রিলে নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু গতবছর নির্মাণকাজের নির্ধারিত সময় শেষ হলেও সড়ক ও সেতুর নির্মাণ কাজ হয়েছে ৭০ শতাংশ। তবে বাস্তবে ৬০ শংতাশের কম নির্মাণ কাজ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে প্রায় দেড় বছর ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই রাস্তা ও সেতু নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গত বছর ৭০ শতাংশ নির্মাণকাজ সমাপ্ত দেখিয়ে প্রায় ১ কোটি ৫৮ লাখ ২৯ হাজার ৬০১ টাকা বিল তুলেছে। বাকি কাজ সমাপ্ত হলে চুক্তি অনুযায়ী ৬৩ লাখ ৬১ হাজার ৮৬২ টাকা পাবে। কিন্তু এখন নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত রয়েছে দুই কিলোমিটার পাকা সড়কের ৩২ মিলিমিটার কাপের্টিং ও সিলকোড। যাতে ব্যয় হবে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এছাড়াও সড়ক ও সেতুর দুই প্রান্তে মাটি ভরাটে ব্যয় হবে প্রায় ২১ লাখ, একটি কালভার্টে ব্যয় হবে প্রায় ১০ লাখ, সড়কের এক অংশ ডাবলু বিএম, সেতুর অ্যাপ্রোস, রেলিংসহ আনুসাঙ্গিক নির্মাণ কাজে ব্যয় হবে প্রায় ১০ লাখ টাকা। সে হিসাবে নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত রয়েছে প্রায় ৯০ লাখ থেকে ৯৫ লাখ টাকার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক উপ-সহকারী প্রকৌশলী জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শেষ করা নির্মাণ কাজের চেয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ বেশি টাকা বিল তুলেছে। বেশি বিল উত্তোলন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সেতুর পশ্চিম প্রান্তে মদামুদন, বকুলতলা, নোয়াখালীটারী, কাচু মধ্যপাড়া গ্রামসহ একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাদ্রাসা, বাজার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর পূর্বপ্রান্তে ঢুলিপাড়া, রামচন্দ্রপুর, সটিপাড়া, মাছহাড়ী গ্রামসহ একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাদ্রাসা, হাট বাজার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ মহেষওয়াল বাজার মোড় থেকে নায়রা সড়ক দিয়ে চলাচল করে। সেতু ও পাকা সড়কের নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় তারা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সারাই নায়রা গ্রামে মানাস খালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে নির্মাণাধীন অসমাপ্ত সেতু। সেতুর রেলিং ও অ্যাপ্রোস এবং দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক নেই। এছাড়া দুই কিলোমিটার সড়কে ইট বালু মিশ্রিত ডাবলু বিএম করা হয়েছে। এর মধ্যে ডাবলু বিএম ছাড়াই সড়কের একাংশ পড়ে আছে। নির্মাণের কোনো সাইনবোর্ড দেখা যায়নি।
স্থানীয় লোকজন সেতুর দুই প্রান্তে কাঠের সাঁকো তৈরি করে চলাচল করছেন। সেখানে নায়রা গ্রামের সহিদুল হক বলেন, সেতু এবং সড়ক নির্মাণের কাজ প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। প্রকৗশলী বা ঠিকাদারের লোকজন আসে না।
নায়রা এলাকার বাসিন্দা মফিজুল ইসলাম জানান, মানাস খালের ওপর একটি সেতু ছিল। ঝুকিপূর্ণ হওয়ায় প্রায় দুই বছর আগে সেতুটি ভেঙে নতুন সেতু নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু সেতুটি এবং সড়কের নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত থাকায় দীর্ঘদিন ধরে আট গ্রামের মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
পল্লিচিকিৎসক ইব্রাহিম মিয়া জানান, উপজেলা সদরসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং হাট-বাজারের সঙ্গে সহজ যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে এই সেতুটি। সংযোগ সড়ক না থাকায় গ্রামের লোকজন যাতায়াতের জন্য বিকল্প হিসেবে সেতুর দুই প্রান্তে কাঠের সাঁকো নির্মাণ করে। তবে সেটিও খুই নড়বড়ে। সাঁকো পারাপার হতে গিয়ে স্কুলগামী শিশুরা এবং পথচারীরা পড়ে গিয়ে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
ওই গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি সদস্য সামছুল হক বলেন, ঠিকাদার সেতু এবং সড়কের নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যান। দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় এলাকার মানুষদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে খুবই সমস্যায় পড়তে হয় স্বজনদের।
বকুলতলা গ্রামের কৃষক রমজান আলী বলেন, সেতুর নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় ধানসহ উৎপাদিত অন্য কৃষিপণ্য সহজে জেলা সদরের বিভিন্ন বাজারে নিতে না পারায় আমাদের কম দামে ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে।
সারাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়নের সেতু ও সড়ক নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তির বিষয়ে উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভায় এবং প্রকৌশলীকে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে ঠিকাদার এনামুল হক বলেন, প্রভাতী প্রকল্পের আওতায় ডাবলু ৭৪ নম্বর প্যাকেজের নির্মাণ কাজ নিয়ে খুবই সমস্যায় পড়েছি। কাজটি আমি করছি না, আমার লাইসেন্স নিয়ে শহরের এক ঠিকাদার টেন্ডারের মাধ্যমে কাজটি পান এবং সেই ব্যক্তি নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতায় ওই ঠিকাদার দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখেছেন। কাজ শুরু করার জন্য উপজেলা প্রকৌশলী বেশ কয়েকবার চিঠিও দিয়েছেন। লাইসেন্স আমার হওয়ার কারণে নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয় থেকে আমাকে চাপ দেওয়া হয়। অবশেষে গত মাসে প্যাকেজের অসমাপ্ত নির্মাণ কাজ করতে পারবো না মর্মে নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে লিখিতভাবে আবেদন করেছি। তবে কাজের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান।
এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান জেমী বলেন, প্রভাতী প্রকল্পের ডাবলু ৭৪ নম্বর প্যাকেজের নির্মাণ কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে পত্র পাঠানো হয়েছে।
তবে ঠিকাদারকে বেশি বিল দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কাজের চেয়ে অতিরিক্তি বিল দেওয়ার কোনো অপশন নেই। কারণ উপসহকারী প্রকৌশলী মাঠপর্যায়ে সরেজমিনে তদারকি করে যে পরিমাণ কাজ হয়েছে সেই মোতাবেক ঠিকাদারকে বিল দেওয়া হয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ে ৭০ শতাংশ নির্মাণ কাজ হয়েছে।
এলজিইডির রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল হক বলেন, প্রভাতী প্রকল্পের ডাবলু ৭৪ নম্বর প্যাকেজের অসমাপ্ত নির্মাণ কাজ শুরু করার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে বার বার তাগিদ দেওয়ার পরও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কার্যাদেশ বাতিলের সুপারিশ করে ঢাকা অফিসে পত্র পাঠানো হয়েছে।
প্রভাতী প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আনিসুল ওয়াহাব খাঁন জানান, দীর্ঘদিন ধরে ডাবলু ৭৪ নম্বর প্যাকেজের নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় ওই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তির বিষয়টি তিনি জানতে পেরেছেন। গত সপ্তাহে তিনি রংপুরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে পরিদর্শন করতে পারেননি। নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় উপজেলা প্রকৌশলী ও উপসহকারী প্রকৌশলীর উদাসীনতা আছে কিনা এবং কাজের চেয়ে ঠিকাদারকে বেশি বিল দেওয়া হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে ডাবলু ৭৪ নম্বর প্যাকেজের কার্যাদেশ বাতিল করার জন্য প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রিটেন্ডার করে ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে প্যাকেজের অসমাপ্ত নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে।##