April 26, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, January 8th, 2023, 8:35 pm

রংপুর অঞ্চলে হাড়কাঁপানো শীতে অগ্নিদগ্ধ দুজন শিশুসহ মৃত্য‘১৯

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক,রংপুর :

রংপুর অঞ্চলে হাড়কাঁপানো শৈত্যপ্রবাহ বইছে। সাত দিনে রংপুর মেডিকেল কলেজ(রমেক) হাসপাতালে শুধু নিউমোনিয়া আর কোল্ড ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৯ শিশু মারা গেছে বলে শিশু ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে। রমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৯ জন অগ্নিদগ্ধ রোগী। তারা সবাই শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেরই শরীরের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এ ছাড়া চিকিৎসাধীন অগ্নিদগ্ধ আরও দুজন মারা গেছেন।অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন মৃত ব্যক্তিরা হলেন, পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নছিমন বেওয়া (৬৮) ও রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার আফরোজা (৩৭)।
এদিকে শনিবার সন্ধ্যা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় আরও পাঁচজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে রমেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের শরীরের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
অপরদিকে বৃষ্টির মতো পড়ছে ঘনকুয়াশা, ফলে দৃষ্টিসীমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে যান চলাচল করতে হচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহের কারণে নিউমোনিয়া, কোল্ড ডায়রিয়া, জ্বর আর শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।সাত দিনে রমেক হাসপাতালে শুধু নিউমোনিয়া আর কোল্ড ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৯ শিশু মারা গেছে বলে শিশু ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে ,রমেক হাসপাতালের তিনটি শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি আছে পাঁচ শতাধিক শিশু। ওয়ার্ডগুলোতে বেডের সংকুলান না হওয়ায় একেকটা বেডে তিনটি করে শিশুকে থাকতে দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। শিশুদের অভিভাবকরা দিন-রাত হয় দাঁড়িয়ে না হয় হাসপাতালের ফ্লোরে বসে বিনিদ্র রাত কাটাতে হচ্ছে।শুধু তাই নয় একটি স্যালাইনের পাইপ দুই-তিন শিশুকে পুশ করার ঘটনাও ঘটছে প্রকাশ্যে। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, সারাদিনে একবার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসেন তাও আবার রেজিস্টার পদমর্যাদার। ইন্টার্ন ডাক্তাররা মাঝেমধ্যে আসেন, চিকিৎসা সেবা দেন। অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার চিকিৎসকরা ওয়ার্ডগুলোতে আসেন না বললেই চলে।সরেজমিনে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে ঘুরে এ ঘটনার সত্যতাও মিলেছে। অথচ দুপুরের পর থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা গভীর রাত পর্যন্ত মোটা অঙ্কের ফি নিয়ে রোগী দেখার ব্যবসা করছেন।এদিকে প্রচন্ড শীতের কবল থেকে রক্ষা পেতে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে গত ১০ দিনে তিন নারী দগ্ধ হয়ে রমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। শনিবার বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়া পাঁচ রোগী। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. পলাশ।তিনি বলেন, “বর্তমানে আগুনে দগ্ধ ২৫ রোগী ভর্তি আছেন আর পাঁচজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।”সরেজমিনে রমেক হাসপাতালের তিন ও চার নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের বেডগুলো ছাপিয়ে ফ্লোরে কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। প্রচন্ড শীতে বৃদ্ধ নারী পুরুষরাই সবচেয়ে বেশি শ্বাসকষ্টসহ নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, স্যালাইন এমনকি স্যালাইন দেওয়ার নিডিলসহ আনুষঙ্গিক সব উপকরণ বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। ডাক্তাররা আসেন, প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে চলে যান। সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। সন্ধ্যার পর কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না।কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থেকে আসা বৃদ্ধা সোনা মিয়ার মেয়ে শারমিলি বেগম জানান, চার দিন ধরে ভর্তি আছেন তার বাবা। কোনো চিকিৎসাই হচ্ছে না। একই কথা বললেন ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থেকে আসা সালেহা বেগম, লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী থেকে আসা সোহানা বেগমসহ অনেকেই।তারা বলেন, “এখানে কার বিরুদ্ধে কে অভিযোগ করবে? আমরা যারা চিকিৎসা নিতে আসছি তারা অসহায়।”সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ৮, ৯ ও ১০ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের। সেখানে পা ফেলার জায়গা নেই। রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে নিউমোনিয়া, কোল্ড ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত শিশুরা। তিন মাস থেকে এক বছরের বাচ্চার সংখ্যাই বেশি। ওয়ার্ডে বেডে জায়গা নেই, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রতি বেডে তিন শিশুকে একটা বেডে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন। একটা স্যালাইনের পাইপ তিন শিশুর শরীরে দেওয়া হচ্ছে।গাইবান্ধার ফুলছড়ি থেকে আসা মনি বেগম জানান, তার এক মাত্র ছেলে জোয়ান ছয় মাস বয়সী, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চার দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। তিনি হাসপাতালের বেড দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ছোট্ট একটা বেডে আমানবিকভাবে তিনটি শিশুকে চিকিৎসা করা হচ্ছে। ছোট্ট একটি বেডে তিন অসুস্থ শিশু থাকলে তাদের মায়েরা কোথায় থাকবে বসারও তো জায়গা নেই।”পুরো হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেলো, এখানে চেইন অব কমান্ড একেবারে নেই। হাসপাতালের একজন সহকারী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ইন্টার্ন ডাক্তাররা শুধু আমাদের অধীনে। বড় বড় চিকিৎসকরা কলেজের অধ্যক্ষের অধীনে তারা আমার কথা শোনে না। বাংলাদেশে কোনো সরকারি হাসপাতালে এমন দৃশ্য দেখবেন না যেখানে ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে ব্যস্ত হাসপাতালে আসে না।
রমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. শরীফুল হাসানের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বলেন, “রংপুর অঞ্চলে প্রচন্ড শীতে নিউমোনিয়া, রোটা ভাইরাসসহ বিভিন্ন রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এক হাজার বেডের এ হাসপাতালে সব সময় দুই হাজারেও বেশী রোগী থাকে। ফলে আমাদের করার কিছু নেই।”
তিনি বলেন, “এক সপ্তাহে ১৯ রোগী মারা গেছে এমন পরিসংখ্যান নেই, তবে অনেক কারণে রোগী মারা যাচ্ছে এটা ঠিক।”আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ তিনজন মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, “পাঁচজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।” তিনি আগুন পোহাতে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেন। তিনি শিশুদের দিনে বাসা থেকে বের না করা এবং গরম কাপড় ছাড়া কোনো অবস্থাতেই ঘরের বাইরে বের না হওয়ার উপদেশ দেন।।