বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী পণ্য চিংড়ি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে চিংড়ি রপ্তানিতে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও রপ্তানি পণ্য হিসেবে চিংড়ি পোশাক খাতের পরে অর্থাৎ দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। এখন এটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সপ্তম স্থানে নেমে এসেছে। তাই হিমায়িত চিংড়ি উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা বাগদা ও গলদার পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছেন। তাদের মতে, ভেনামি চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে ইউরোপ ও আমেরিকা তথা বিশ্ববাজারে রপ্তানি করতে পারলে চিংড়ি রপ্তানিতে সুদিন ফিরে আসবে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম হুমায়ুন কবির ইউএনবিকে জানান, এশিয়ায় যে ১৫ টি দেশ চিংড়ি চাষ করে ও ইউরোপ, আমেরিকাসহ অন্যান্য বাজারে রপ্তানি করে তার মধ্যে ১৪ টি দেশ ইতোমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানি করছে। কিন্তু আমরা এই চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও রপ্তানি করতে না পারায় অন্য দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছি।
২০১৩-২০১৪ অর্থবছর থেকে ২০২০-২০২১ পর্যন্ত চিংড়ি রপ্তানির চিত্রে দেখা যায় ক্রমান্বয়ে বিশ্ববাজারে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ৫১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ৪৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৪৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৪০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৩২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চিংড়ি খাতে রপ্তানি আয় হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো।
বর্তমানে বাংলাদেশে ১০৫ টি হিমায়িত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কাঁচামালের অভাবে নাজুক অবস্থায় চলছে ৬০ টি। আর বাংলাদেশের চিংড়ি চাষ হয় দুই লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে ১৬০ দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি গলদা ও বাগদা উৎপাদন করা হয়। তবে বছরে দুইবারের বেশি কোনো জমিতে গলদা ও বাগদা উৎপাদন করা যায় না। তাছাড়া গলদা ও বাগদার উৎপাদন খরচ অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন চাষীরা।
অন্যদিকে উচ্চফলনশীল, কম উৎপাদন খরচ, সস্তা ও সহজলভ্য ভেনামি চিংড়ি বিশ্ব বাজার দখল করে নিয়েছে। অথচ আমাদের চিংড়ি শিল্প মার খাচ্ছে। সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তর ভেনামি চিংড়ি চাষের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভেনামি চাষের শর্তসাপেক্ষে পাইলট প্রজেক্টের অনুমতি মিলেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, যেখানে প্রতি হেক্টরে ১৬০ দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি গলদা ও বাগদা উৎপাদন করা হয়, সেখানে প্রতি হেক্টরে ১১০ দিনে উচ্চফলনশীল এই চিংড়ি ১০ থেকে ১৫ মেট্রিক টন উৎপাদন করা সম্ভব এবং একই জমিতে বছরে তিনটি ফসল পাওয়া যাবে।
মৎস্য অধিদপ্তর থেকে নীতিগতভাবে ভেনামি চিংড়ির জন্য পাইলট প্রজেক্ট পাওয়া জেবিএস (জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা) এর স্বত্বাধিকারী প্রফুল্ল কুমার রায় জানান, পরীক্ষামূলক চাষে এর ফলাফল সন্তোষজনক। প্রতি হেক্টরে ১১০ দিনে পাঁচ থেকে সাত মেট্রিক টন উৎপাদন হলেও এখন সেটি ১০ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে যদি বিশ্ববাজারে রপ্তানি করা যায় তবে আমাদের চিংড়ি শিল্পের সুদিন ফিরে আসবে।
পাইলট প্রজেক্টের আরেক স্বত্বাধিকারী শ্যামল কুমার দাস বলেন, মৎস্য অধিদপ্তর দেরিতে হলেও বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি পরীক্ষামূলকভাবে চাষের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বাণিজ্যিকভাবে তা কার্যকর হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারতের মত চার থেকে ছয় লাখ মেট্রিক টন ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করতে পারবে।
এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, ভেনামি চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও রপ্তানি করলে তিন থেকে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা যাবে এবং বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে চিংড়ির হারানো বাজার ফিরে পাবে।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল জানান, বাংলাদেশের গলদা ও বাগদার উৎপাদন পৃথিবীর সব থেকে কম। অন্যদিকে ভেনামি উচ্চফলনশীল, উৎপাদন খরচ কম, সস্তা ও সহজলভ্য এবং সুস্বাদু। এই কারণেই এই চিংড়ি বাজার দখল করে রেখেছে।
খুলনার গল্লামারী বাজারের এক চিংড়ি ক্রেতা খোদেজা বেগম জানান, ভেনামি চিংড়ি দামে কম ও খেতে মজাদার।
চিংড়ি বিক্রেতা রবিউল শেখ জানান, প্রথমদিকে এই চিংড়ির চাহিদা কম থাকলেও দিনে দিনে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এশিয়ার চিংড়ি উৎপাদনকারী ১৫ টি দেশের মধ্যে ১৪ টি দেশ এই চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানি করে। এর মধ্যে চীন ১৯৮৮ সালে, ফিলিপাইন ১৯৯৭, থাইল্যান্ড ১৯৯৮, ভিয়েতনাম-মায়ানমার-কম্বোডিয়া ২০০০, ভারত-মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া ২০০১, সিঙ্গাপুর-দক্ষিণ কোরিয়া ২০০৩, ইসরাইল ২০০৪, ইরান ২০০৬ ও সৌদি আরব ২০০৮ সালে ভেনামি চিংড়ির চাষ শুরু করে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও ভেনামি চিংড়ি চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু করতে পারেনি।
ভেনামি চিংড়ি চাষ দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রসেনজিৎ জানান, এই চিংড়ি উৎপাদনে প্রকৃতিতে কোনো প্রভাব পড়ে না। বরং চিংড়ি ঘেরের চার পাশে সবজি চাষ করা যায়।
প্রতি বছর ভারত ছয় দশমিক পাঁচ লাখ মেট্রিক টন, ভিয়েতনাম চার লাখ মেট্রিক টন এবং থাইল্যান্ড তিন দশমিক পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানি করে। বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন ও বাণিজ্যের পরিমাণ শতকরা ৭৭ ভাগ। তাই দাবি উঠেছে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার।
—ইউএনবি
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি