November 27, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, April 7th, 2022, 9:05 pm

রাজধানীজুড়ে অসহনীয় যানজট, সমস্যার সমাধান কোন পথে

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

তিলোত্তমা নগরী ঢাকা এখন বহুমুখী সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর জীবনযাত্রা ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। সবচেয়ে প্রকট ও জটিল সমস্যা হলো যানজট। এ নিয়ে অনেক বছর ধরে অনেক কথা বলা হচ্ছে, নানা রকমের উদ্যোগের কথাও মাঝেমধ্যে শোনা যায়, কিন্তু এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, বরং তা দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। যানজটের এ অবস্থার জন্য ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯-এ আমাদের অবস্থান প্রথম। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারতের কলকাতা। ঢাকার রাস্তায় এত ট্র্যাফিক জ্যাম কেন? আর এর সমাধানই বা কী? এই প্রশ্ন করলে রাজধানীর শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত প্রত্যেকের কাছেই কোনো না কোনো জবাব পাবেন আপনি। সমস্যাটা সবাই জানেন আর সকলের কাছেই এর একটি সমাধান আছে! বিষয়টি অনেকটা দেশে ডাক্তার বেশি না রোগী বেশি – সেই প্রশ্নের মতো। কিন্তু সকলে সমস্যা সমাধানের নানা পরামর্শ দিলেও ঢাকায় যানজট পরিস্থিতির উত্তোরত্তর অবনতি ঘটছে। কয়েকঘণ্টা ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থাকাই যেন এ শহরে সাধারণ নিয়ম। অর্থাৎ, তেমনটা যদি না ঘটে তাহলেই তা ব্যতিক্রম এবং বিস্ময়কর। ঢাকা শহরের যানজটের কারণ কী – এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। যানজট নিরসনে নেয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা এবং মহাপরিকল্পনা। এ কারণেই আজ ঢাকার কোনো সড়ক হয়ত ‘ওয়ান ওয়ে, আবার কাল হয়ে যাচ্ছে ‘টু ওয়ে’। আজ এই সড়কে রিক্সা চলাচল বন্ধ, কাল আবার খুলে দেয়া হচ্ছে। কোনো রাস্তায় আবার চলছে আইল্যান্ড বা সড়ক দ্বীপ তৈরি এবং ভাঙার খেলা।
প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা কম
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের জাতীয় সংসদে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি আধুনিক নগরীতে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ রাস্তা বা সড়ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র সাত থেকে আটভাগ। এর মানে হলো, প্রয়োজনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ সড়ক আছে এই শহরে। ঢাকা শহরের মোট এলাকা ১৩৫৩ বর্গ কিলোমিটার আর ঢাকার বর্তমান রাস্তার আয়তন ২,২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক।
অন্যদিকে ট্র্যাফিক বিভাগের হিসাব মতে, সেই সড়কের কম করে হলেও ৩০ ভাগ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারদের হাতে। এ ছাড়া ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই পায়ে হেঁটে চলেন নগরবাসী। ফলে যানজটের সঙ্গে আছে জনজট।
সড়ক চলে গেছে প্রাইভেট কারের দখলে
ঢাকায় ১৫ ভাগ যাত্রী দখল করে আছেন মোট সড়কের ৭০ ভাগ। স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপি-র হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় কম-বেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন। এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা। বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তারা গণপরিবহন সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পান।
ব্যস্ত সড়কেই পাকিং
এবার পার্কিং-এর চরিত্রটি দেখা যাক। ঢাকায় মতিঝিলে সাধারণ বীমা অফিসের উল্টোদিকে একটি বহুতল ভবনে ৩৭০টি গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা আছে। এর পাশাপাশি ৩৭ তলা সিটি সেন্টারেও প্রায় সাড়ে ৫০০টি গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া বসতবাড়ি এবং কিছুকিছু অফিসে নিজস্ব গাড়ি রাখার ব্যবস্থা আছে ঢাকায়। এর বাইরে পুরো রাজধানীতে আর কোনো সুনির্দিষ্ট পার্কিং ব্যবস্থা নেই। তাই অফিস এবং ব্যবসা-বাণিজ্য চলাকালীন সময়ে ৮০ ভাগ গাড়ি রাস্তায় যত্রতত্র পার্কিং করা হয়। শুধু তাই নয়, সেগুলো থেকে নিয়মিত টোলও আদায় করা হয়।
শহরের মধ্যে রেল ক্রসিং, ভিআইপি মুভমেন্ট
ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে এখনো রেলগাড়ি চলাচল করে। ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে রেল লাইন যাওয়ার ফলে ১৭টি পয়েন্টে রাস্তা বন্ধ করে ট্রেন যাওয়ার ব্যবস্থা করায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এসব পয়েন্টে দিনে কমপক্ষে ১০ বার যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এরসঙ্গে আছে ভিআইপি মুভমেন্টো। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজনীতিবিদদের মুভমেন্টের সময় দীর্ঘক্ষণ কিছুকিছু সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে শুধু তাঁদের চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই তখন পার্শ্ববর্তী সরকগুলোতে সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট।
ঠেলাগাড়ি-বাস একই রাস্তায়
এই শহরে একই রাস্তায় দ্রুতগামী যানবাহন আর ধীর গতির যানবাহন চলাচল করে, তাও আবার একসঙ্গে। একই সড়কে বাস-মিনিবাস, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ভ্যান, এমনকি ঘোড়ার গাড়িও চলে। ঢাকায় এখনো নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা সাত লাখ। কিন্তু বাস্তকে ২০ লাখ প্যাডেল চালিত রিকশা চলাচল করে এই শহরে। ফলে যানবাহনের গতি যায় কমে।
আইন মানতে চায় না কেউ
ঢাকার সড়ক ব্যবহারকারীরা – মানে যানবাহন ও পথচারী – কেউ-ই আইন মানে না। সুযোগ পেলেই ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘন করে তারা। ভুল দিক বা ‘রং সাইড’ দিয়ে যানবাহন চালানো, ট্র্যাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, ফুটপাথ দিয়ে যানবাহন চালানো ঢাকার একটি পরিচিত চিত্র। সবাই আগে যেতে চায়, তা সে যেভাবেই হোক না কেন। এর ফলাফল হলো, কেউই আর শেষ পর্যন্ত আগে যেতে পারে না। তার ওপর ফুটওভার ব্রিজ বা ফুট ব্রিজ ব্যবহার না করে পথচারীরা মূল সড়কের মাঝখান দিয়ে রাস্তা পারাপার করে সড়কের গতি স্লথ করে দেন।
অপ্রতুল পার্কিং স্পেস
ঢাকার প্রগতি সরণীর একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রের সামনের সড়কের ফুটপাথটি দখল করে রেখেছে গাড়ি। এ শহরের বেশিরভাগ ভবনেরই নেই নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা। ফলে এসব ভবনে আসা গাড়িগুলো পার্ক করা হয় ফুটপাথে কিংবা সড়কের ওপর, যেটা যানজটের অন্যতম একটি কারণ।
রাস্তার ভাঙার কারণে জ্যাম
ঢাকার যানজটের অন্যতম একটি কারণ দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তা খোড়াখুড়ি। ঢাকার গুলশানের এ সড়কটিতে স্যুয়ারেজের লাইন মেরামতের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে কাজ চলছে। ফলে দিনেরবেলায় সড়কটিতে লেগেই থাকছে যানজট।
সেতু নির্মাণের জন্য…
ঢাকা শহরের যানজটের কারণের মধ্যে আছে দীর্ঘ সময় ধরে উড়াল সেতু নির্মাণও। উড়াল সেতু নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখা হচ্ছে সড়কের বেশিরভাগ জায়গায়। ফলে তৈরি হচ্ছে যানজট। তাছাড়া এসব উড়াল সেতু নির্মাণে সঠিক পরিকল্পনারও অভাব আছে বাংলাদেশে।
যানজটের ক্ষতি
রাজধানীতে যানজট এক নির্মম বাস্তবতা। এতে আটকা পড়ে প্রতিদিন রাস্তায় অপচয় হয় অসংখ্য কর্মঘণ্টা। ২০১৭ সালে ঢাকার যানজট নিয়ে বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীতে যানজটে প্রতিদিন ৩৮ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) ‘মিটিগেটিং ট্রাফিক কনজেশন ইন ঢাকা : অ্যাপ্রোপ্রিয়েট পলিটিক্যাল এজেন্ডা’ (ঢাকার যানজট কমানো : কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি) শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এতে বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। গবেষকদের মতে, যদি রাজধানীর যানজট ৬০ শতাংশ কমানো যায়, তাহলে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো যাবে। যানজটে সাধারণ মানুষের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। উন্নতির বদলে দিনের পর দিন পরিস্থিতির অবনতিই হচ্ছে।
ঢাকার যানজট নিরসনে আরও বেশি সড়ক নির্মাণ, রিকশা চলাচল আবাসিক এলাকাভিত্তিক করা, ফুটপাতগুলো ব্যবহার উপযোগী করা, অটোমেটিক ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা বাস্তবায়নসহ রেল ও নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। মূলত যানজট নিরসনে দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা দরকার।