নিজস্ব প্রতিবেদক:
মগবাজার-তেজগাঁও ফ্লাইওভার থেকে কাওরানবাজার দিয়ে নামতে গিয়ে সময় লাগলো ২০ মিনিটেরও বেশি। গেল কয়েকদিনের মতো অসহনীয় যানজটের অভিজ্ঞতায় ধরেই নেওয়া যায় ধানমিন্ডর রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত পৌঁছাতে আরও আধাঘণ্টা হয়তো লেগে যাবে। কিন্তু না, মোটরসাইকেলে একটানে ৫ মিনিটেরও কম সময়েই পৌঁছানো গেল গন্তব্যে। আবার একই সড়কের অপরপাশ তখন গাড়িতে পরিপূর্ণ। শুধু এই সড়কই না, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অনেক সড়কেই এমন চিত্র দেখা গেছে। রাজধানী ঢাকার তীব্র যানজট নিরসনে দায়িত্বরত সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হলেও বাস্তবায়ন তেমন চোখে পড়ে না। যানজট নিয়ন্ত্রণে কখনও রিকশা নিয়ন্ত্রণ, কখনও ব্যক্তিগত গাড়ির ‘জোড়-বিজোড় থেরাপি’, আবার কখনও ডিজিটাল ট্রাফিক যন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় এমন সিদ্ধান্ত প্রয়োগও করা হয়েছে। যদিও সিদ্ধান্তের উপর অটল থাকতে পারছে না দায়িত্বরত সংস্থাগুলো। এ প্রসঙ্গ টেনে কথা বলতে বলতেই যানজটে দীর্ঘসময় আটকে থাকা বিরক্ত এক মোটরসাইকেল চালক টিপ্পনী কেটে বললেন, ‘কর্তৃপক্ষের কথার মতো যানজটও একেক সময় একেক রূপ ধারণ করছে।’ ঢাকা শহরের যানজটের প্রকৃত কারণ কী এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। যানজট নিরসনে নেওয়া হয়েছে নানান পরিকল্পনা-মহাপরিকল্পনা। কোথাও কোথাও সড়ককে ওয়ানওয়ে, আবার কোথাও কোথাও টু ওয়ে করে দেওয়া হচ্ছে। আজ এই সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ, তো কাল আবার খুলে দেওয়া হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও হঠাৎই দেখা যায় সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। আর এসব অপরিকল্পিত কর্মকা-েই যানজটের চিত্র ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে বলে মনে করেন নগরবিদরা। রোববার (২৭ মার্চ) সকালে নগরীর রাজারবাগ ট্রাফিক সিগন্যালে গিয়ে দেখা গেছে, খিলগাঁও রেলগেট থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত সড়ক জুড়ে তীব্র যানজট রয়েছে। অপরদিকে ফকিরাপুল থেকে খিলগাঁও রেলগেট পর্যন্ত সড়কে যানবাহনের তেমন চাপ নেই। একই সময় বাংলামোটর মোড়ে দেখা গেছে যানবাহনের ভয়াবহ রূপ। একটু সামনে গিয়ে আবার দেখা গেছে উল্টো চিত্র। কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ার থেকে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত সড়ক ছিলো ফাঁকা। একই সময় ফার্গমেট ধানমন্ডি-২৭ পল্টন ও গুলিস্তান এলাকায় তীব্র যানজট দেখা গেছে। একই সময়ে উত্তরা থেকে কুড়িল হয়ে মালিবাগ সড়কে যানজট দেখা গেছে। কিন্তু সড়কটির বিপরীত অংশে যানবাহনের তেমন চাপ দেখা যায়নি। সম্প্রতি সকালের অফিস সময়ে নগরীর যনজট ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে দেখা যাচ্ছে। এ থেকে মুক্তি দিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম নগরীতে জোড় বিজোড় সংখ্যার ভিত্তিতে যানবাহন পরিচালনার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, নগরীতে মাত্র ৬-৮ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে। যানজটনের জন্য এই গাড়ি ৯০ শতাংশ দায়ী। মাত্র এ সংখ্যক মানুষের জন্য বাকি ৯২ শতাংশ নগরবাসীকে দুর্ভোগের যন্ত্রণায় রাখা যায় না। তার দাবি, মাসের জোড় তারিখগুলোতে জোড় সংখ্যাধারী ব্যক্তিগত গাড়ি এবং বিজোড় তারিখগুলোতে বিজোড় সংখ্যাধারী যানবহন রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দিলে শহরে যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে। জানতে চাইলে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থা সিটি করপোরেশনকে দিলে গাড়ির নম্বর প্লেটের নম্বরটি জোড় না বিজোড়, সেই ভিত্তিতে রাজধানীর রাস্তায় গাড়ি নামাবেন গাড়ির মালিকরা। নম্বর প্লেটে যাদের জোড় সংখ্যা রয়েছে তারা জোড় তারিখের দিনে গাড়ি চালাতে পারবেন। পরের দিন চলবে বিজোড় সংখ্যার গাড়ি। এতে করে অর্ধেক গাড়ি কমে আসবে। পাশাপাশি যানজটও কমবে।’ তিনি বলেন, এখন দেখা যাচ্ছে একটি গাড়িতে একজন বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো হচ্ছে। অফিসে যাচ্ছেন অনেকেই। জোড় বিজোড় ভিত্তিতে গাড়ি চালানো হলে পাশের গাড়ি মালিকের সঙ্গে সমন্বয় করে চলাচল করতে পারবেন। ফলে রাস্তায় গাড়ির চাপ কমবে। নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘জোড়-বিজোড় তত্ত্ব প্রয়োগে যানজট কিছুটা কমলেও ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপটে এটা বাস্তবসম্মত না। বিশ্বের কয়েকটি শহরে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাতিল করেছে। আমরা যেখানে ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে পারি না, সিগন্যাল পার্কিং এনফোর্স কারতে পারি না, সেখানে এ থিওরি কীভাবে কার্যকর হবে? এটা কার্যকর করতে হলে আগে গণপরিবহনকে উন্নত করতে হবে। যাতে করে একজন ব্যক্তি এক দিন গাড়ি ব্যবহার না করেও নিশ্চিন্ত মনে সুন্দরভাবে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন। এই অবস্থা ঢাকায় তৈরি করতে আরও অনেক সময় লাগবে। অপরদিকে দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্বগ্রহণ করার পর ধীরগতির যানবাহন রিকশার লাইসেন্স দেওয়া শুরু করেন। তখন তিনি বলেছিলেন, রিকশাকে শৃঙ্খলার মধ্যে এনে অলিগলিতে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে। কোনও রিকশা প্রধান সড়কগুলোতে আসতে পারবে না। কিন্তু তার সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু লাইসেন্স পেয়ে নগরীতে প্রধান সড়কগুলোতে দেদার চলছে চলাচল করছে এই বাহনটি। নগরীতে যানজটের জন্য এই ধীরগতির বাহনটিকেও দায়ী করা হয়। অপরদিকে রাজউক মনে করছে সকালের অফিস সময়ে যানজটের অন্যতম কারণ ব্যক্তিগত গাড়ি। একই সময়ে নগরীর স্কুলগুলোও চালু হয়। এই দু’য়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় যনজটের রূপ ভয়ঙ্কর ধারণ করছে। প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু সকাল ৯টায় চালু হচ্ছে সেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ১১টায় চালু হলে সময়ের সমন্বয় হবে। এতে কারণে একই সময়ে বিপুল সংখ্যক যানবাহনের চাপ পড়বে না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল এডিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলামবলেন, সকালের অফিস ও স্কুল সময় প্রায় একই। এই দুই শ্রেণির প্রতিষ্ঠানের শুরুর সময়টা পৃথক করা গেলে যানজট সহনীয় পয়ে আসবে। যানজট থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে হলে অফিস ও স্কুল সময় আলাদা করে নির্ধারণ করতে হবে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি