অনলাইন ডেস্ক :
টসের সময় ঝুলন গোস্বামীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন ভারতের অধিনায়ক হারমানপ্রিত কৌর। ব্যাটিংয়ের সময় মাঠে নেমে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ঝুলন পেলেন ‘গার্ড অব অনার।’ বোলিংয়ে তিনি জ¦লে উঠলেন বরাবরের মতোই। ম্যাচ শেষে তাকে কাঁধে তুলে মাঠ প্রদক্ষিণ করলেন সতীর্থরা। দল জিতল রোমাঞ্চকর ম্যাচ, সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করল ইংলিশেদের। সব মিলিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের রানীর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষটাও হয়ে রইল দারুণ স্মরণীয়। সেই ২০০২ সালের জানুয়ারিতে চেন্নাইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে শুরু হয়েছিল যে ক্যারিয়ার, ক্রিকেট বিশ্বের নানা অলিগলি ঘুরে, ভারতের নারী ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়ে, নিজেকেও কিংবদন্তির পর্যায়ে তুলে নিয়ে সেই ক্যারিয়ার থেমে গেল ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই, ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে। ঝুলনের বিদায়ী আয়োজনের সবই ছিল প্রস্তুত। এবার ইংল্যান্ড সফরের আগেই বার্তা পান, নির্বাচকরা তাকাতে চান সামনে। পারফরম্যান্স তার খারাপ ছিল না একদম। তবে প্রায় ৪০ ছুঁইছুঁই বয়সে আর লড়াইয়ের রসদ পাননি। মাথা উঁচু করে বিদায়ের সিদ্ধান্তই নেন তিনি। সিরিজ শুরুর আগে থেকেই ভারতীয় দলের ক্রিকেটাররা বলছিলেন, প্রিয় ‘ঝুলু দিদিকে বিদায়ী উপহার দিতে চান তারা। সেই প্রতিজ্ঞাকে কাজে পরিণত করে তারা প্রথম দুই ম্যাচ জিতে নিশ্চিত করে ফেলে সিরিজ জয়। শনিবার শেষ ম্যাচ তাই কার্যত রূপ নেয় ঝুলনের ম্যাচে। লর্ডসে ১৬৯ রানের পুঁজি নিয়েও ভারত ম্যাচটি জিতে নেয় ১৬ রানে। অভিষেক ম্যাচে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে চেন্নাইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ ওভারে ১৫ রানে ২ উইকেট নিয়েছিলেন ঝুলন। ২০ বছর পর বিদায়ী ম্যাচে তার বোলিং ফিগার ১০-৩-৩০-২! ৩৫৫ উইকেট নিয়ে শেষ হলো তার ক্যারিয়ার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম বোলার তিনিই। ওয়ানডেতে তার উইকেট ২৫৫টি, আর কোনো বোলারের নেই ২০০ উইকেটও। ২০ বছরের বেশি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, তিন সংস্করণেই ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব, পরিসংখ্যানের পাতায় এমন অনেক কীর্তিতে লেখা হয়ে আছে তার নাম। তবে তার অবদান ¯্রফে কিছু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের নারী ক্রিকেটকে পরের ধাপে পৌঁছে দেওয়া, জনপ্রিয় করে তোলার অগ্রপথিকদের একজন তিনি। উপমহাদেশ থেকেও পেস বোলিংয়ে বিশ্ব শাসন করা যায়, এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার নায়কও তিনি। ভারতের নারী ক্রিকেটের কয়েক প্রজন্মকে তিনি গেঁথে রেখেছিলেন এক সুতোয়। ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসেই তার নাম খোদাই হয়ে থাকবে তাই আলাদা করে। সুইংয়ের কারিকুরি ও স্কিলের গভীরতা তার খুব বেশি ছিল না। তবে লাইন-লেংথ, বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং, আগ্রাসন আর লড়িয়ে মানসিকতা দিয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। এমন একজনের বিদায় বেলায় মাঠে সতীর্থদের আবেগের প্রকাশ দেখা যায় যথেষ্ট। সামাজিক মাধ্যমেও ছিল ঝুলনের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জোয়ার। ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় নাম শচিন টেন্ডুলকার টুইটারে শুভেচ্ছা জানান ঝুলনকে, “ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য যা কিছু করেছো, সবকিছুর জন্য কৃতজ্ঞতা। অসাধারণ একটি ক্যারিয়ারের জন্য অভিনন্দন।” ভারতীয় ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তি, মাঠের ভেতরে-বাইরে অনেক লড়াইয়ে ঝুলনের সঙ্গী, কিছুদিন আগে অবসরে যাওয়া মিতালি রাজের কথায় ফুটে উঠল, কোথায় নিজেকে আলাদা করে তুলেছেন ঝুলন। “একজন ফাস্ট বোলার হয়েও মেয়েদের ক্রিকেটে তার যে লম্বা ক্যারিয়ার, এটা অবিশ্বাস্য। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায় থেকেই একসঙ্গে খেলেছি আমরা। খেলাটির প্রতি ঝুলনের নিবেদন, তার বরাবরের তাড়না, এসব সবার জন্যই শিক্ষণীয়। ভারতের জার্সি তোমাকে মিস করবে। ভবিষ্যতের জন্য তোমাকে শুভ কামনা, ঝুলু!” শেষ সিরিজের প্রথম ম্যাচে ঝুলনের প্রাপ্তি ছিল দুই উইকেট, শেষ ম্যাচেও দুটি। সাবেক অধিনায়ক ও ভারতীয় বোর্ডের প্রধান সৌরভ গাঙ্গুলি মনে করিয়ে দিলেন, ঝুলনের শেষটাও কতটা উজ্জ্বল। “দুর্দান্ত এক ক্যারিয়ারৃজয় দিয়ে শেষ হওয়াটা দারুণভাবে মানিয়ে গেছেৃব্যক্তিগতভাবেও দারুণ এক সিরিজ কাটিয়ে শেষ করছে সে। ভারতীয় নারী খেলোয়াড়দের জন্য সে আদর্শ হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।” ভারতের নারী ক্রিকেটের জাগরণে ঝুলনের অবদানের কিছুটা ফুটে উঠল সাবেক ব্যাটসম্যান ও ভারতের ক্রিকেট একাডেমির বর্তমান প্রধান ভিভিএস লক্ষণের কথায়। “প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তুমি অনুপ্রাণিত করেছো। ২০ বছর ধরে ছুটে গেছো নিরন্তর এবং দেশের হয়ে উজাড় করে দিয়েছো সেরাটা। এর চেয়ে বেশি গর্বিত আমরা আর হতে পারতাম না। অসাধারণ একটি ক্যারিয়ারের জন্য অনেক অভিনন্দন, সামনের পথচলার জন্য শুভ কামনা।” বিরাট কোহলি তুলে ধরলেন ঝুলনের সাহসিকতা ও হার না মানা মানসিকতার দিকটি। “ভারতীয় ক্রিকেটের দারুণ এক সেবকৃ দুর্দান্ত এক ক্যারিয়ারের জন্য আপনাকে অভিনন্দন। অসংখ্য নারীকে অনুপ্রাণিত করেছেন খেলাটিকে আপন করে নিতে। আপনার দৃঢ়তা ও আগ্রাসন সবসময়ই আলাদা করে ফুটে উঠেছে। আপনার জন্য সবটুকু শুভ কামনা।” ভারতের এই সময়ের সেরা ফাস্ট বোলার জাসপ্রিত বুমরাহও বিদায়ী শুভেচ্ছা জানান ঝুলনকে। “ক্রিকেট খেলাটায় আপনার অবদান অনেকৃ এত এত মানুষকে আপনি অনুপ্রাণিত করেছেন এই খেলায় আসতে! চোখধাঁধানো এক ক্যারিয়ারের জন্য অভিনন্দন, সামনের সবকিছুর জন্য শুভ কামনা।” ঝুলনকে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরাদের কাতারে রাখছেন ভারতের সীমিত ওভারের দলের সহ-অধিনায়ক লোকেশ রাহুল। “খেলাটির সর্বকালের সেরাদের একজনৃ ক্রিকেটের প্রতি আপনার ভালোবাসা, আবেগ ও নিবেদন অনুপ্রাণিত করেছে অনেককে। দারুণ সব মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা।” ধারাভাষ্যকার ও সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটার মেলানি জোন্সের টুইটে ফুটে উঠল যেন ঝুলনের ক্রিকেটার ও মানুষ ঝুলনের সবটুকুই। “ওই রান আপ। তার মুখের জিঙ্ক। দীর্ঘস্থায়িত্ব। রেকর্ডগুলো। বড় সব শিকার। সেই হাসি। স্কিল। বিনয়। লেগে থাকা। সিংহহৃদয়। সেরাদের সেরা। আইকন। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ।”
আরও পড়ুন
কানপুর টেস্টে মুমিনুলের সেঞ্চুরি, বাংলাদেশের সংগ্রহ ২৩৩ রান
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার বিয়য়ে যা বললেন তামিম
অক্টোবরে বাংলাদেশে সফরে আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা