রানা প্লাজা দুঘর্টনায় বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে বেকারত্বের হার হ্রাস পেলেও বর্তমানে কর্মহীন রয়েছেন ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর উপলক্ষে বুধবার (১২ এপ্রিল) ‘রানা প্লাজা দুঘর্টনা: ট্রাজেডি এবং ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক সমীক্ষায় এই ফলাফল উপস্থাপন করে একশনএইড বাংলাদেশ।
একশনএইড বাংলাদেশ-এর এক সমীক্ষা অনুসারে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে বেকারত্বের হার হ্রাস পেলেও বর্তমানে ৫৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ কর্মহীন রয়েছেন। এদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ গত পাঁচ থেকে আট বছর ধরে কর্মহীন, আর পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ কর্মহীন রয়েছেন গত তিন থেকে চার বছর ধরে।
একশনএইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বেঁচে যাওয়া ২০০ জনের মধ্যে এই জরিপ পরিচালিত হয়েছে।
এর মধ্যে ৬৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ নারী এবং ৩০ দশমিক পাঁচ শতাংশ পুরুষ।
সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলে বেঁচে থাকাদের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত শারীরিক স্বাস্থ্যের অবস্থা, মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতা এবং আর্থিক অবস্থাসহ বেশ কয়েকটি মূল বিষয় তুলে ধরা হয়।
সমীক্ষায় পাওয়া তথ্য মতে, তাদের বেকারত্বের পেছনে মূল কারণ হলো তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যগত অবস্থা। তবে এই হার গত বছরে ছিল ৬৭ শতাংশ, যা বর্তমানে কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে, ২১ শতাংশ বলেছেন যে তারা কোন উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না।
এই ফলাফল থেকে দেখা যায় যে শারীরিকভাবে সক্ষমতা থাকা অনেক শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমীক্ষা আরও বলছে, রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের শারীরিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। সম্পূর্ণরূপে স্থিতিশীল বলে দাবি করা জীবিতদের অনুপাত ২০১৪ সালে ছিল ১৭ শতাংশ যা ২০২৩ সালে এসে সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ হয়েছে।
এবছর ২২ দশমিক পাঁচ শতাংশ বলেছেন তাদের শারীরিক স্বাস্থের অবনতি হয়েছে যা ২০১৪ সালে ছিল ৯ শতাংশ।
উত্তরদাতাদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৬ দশমিক আট শতাংশ) উল্লেখ করেছেন যে তারা পিঠের ব্যথায় ভুগছেন, এক চতুর্থাংশ (২৪ দশমিক ছয় শতাংশ) মাথা ব্যথার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন।
অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে শ্বাসকষ্ট, হাত ও পায়ে আঘাত, দাঁড়াতে ও সঠিকভাবে হাঁটতে না পারা, দৃষ্টিশক্তি ও কিডনির সমস্যা ইত্যাদি।
মনোসামাজিক স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ অনুভব করা লোকের হার হ্রাস পেলেও মোটামুটি স্থিতিশীল বলে দাবি করার হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ইতিবাচক প্রবণতা সত্ত্বেও, এখনও ২৯ শতাংশ মানসিক ট্রমার মধ্যে বেঁচে আছেন, যাদের অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে।
মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত ২৯ শতাংশের মধ্যে ৫৭ দশমিক আট শতাংশ উত্তরদাতারা বলেছেন তাদের মধ্যে ভবন ধসে পড়ার ভয় কাজ করে।
এছাড়া ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ তাদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।
সমীক্ষার ফলাফলে আরও দেখা যায় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে সেরে উঠেছে ৩৬ দশমিক তিন শতাংশ বর্তমানে পোশাক কারখানায় কর্মরত রয়েছেন।
গত বছর এ হার ছিল ১৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ।
সমীক্ষা অনুযায়ী, বেঁচে ফেরা পোশাক শ্রমিকরা স্বাস্থ্যঝুঁকি কাটিয়ে ওঠার পরে কাজ ফিরে আসছে, যা তাদের সামগ্রিক কর্মসংস্থানের ইতিবাচক বিকাশকে প্রতিফলিত করে।
সমীক্ষায় আরও প্রকাশ পায়, বেঁচে যাওয়াদের পরিবারের আয়ের পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। জীবিতদের অর্ধেকের মাসিক পারিবারিক আয় (৪৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ) ১০ হাজার এক থেকে ১৫ হাজার টাকা, ১৯ দশমিক পাঁচ শতাংশের মাসিক পারিবারিক আয় ১৫ হাজার এক টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা, এবং ১১ শতাংশের প্রতি মাসে আয় ২০ হাজার টাকার বেশি।
উত্তরদাতাদের বেশিরভাগের পরিবারের আয় তাদের পারিবারিক খরচ মেটাতে অপর্যাপ্ত। প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা জানিয়েছেন (৪৭ শতাংশ) তাদের মাসিক ব্যয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা এবং তারা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরী ব্যয় এর মতো অপ্রত্যাশিত ব্যয় এর জন্য কোন সঞ্চয় নেই।
সমীক্ষায়, আরও ২০০ জন বর্তমান পোশাক শ্রমিকের কাছে তাদের কারখানায় নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় যার বেশিরভাগ উত্তরদাতা ছিলেন নারী (৮৪ দশমিক ছয় শতাংশ)।
উত্তরদাতাদের অর্ধেকেরও বেশি (৫২ দশমিক দুই শতাংশ) মনে করেন যে কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা অপর্যাপ্ত রয়েছে। ৯৩ শতাংশ উত্তরদাতা তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের কাজ করার ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান রয়েছেন।
প্রায় ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা তাদের কারখানায় উপস্থিত বিভিন্ন ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন, যার মধ্যে রয়েছে যন্ত্রপাতি সমস্যা, অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, অপর্যাপ্ত বায়ু চলাচল এবং আলোক স্বল্পতা, সেইসঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাব।
উত্তরদাতাদের প্রায় ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ বলেছেন যে তাদের কারখানায় অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, ২৩ দশমিক চার শতাংশ বলেছেন যে তাদের কারখানায় জরুরি অগ্নি নির্গমন ব্যবস্থা নেই। ২০ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা উল্লেখ করেছেন যে তাদের কারখানায় কোন চিকিৎসা কেন্দ্র নেই, এবং ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ জানিয়েছেন সেখানে কোনও ডাক্তার বা নার্স নেই।
বহুপাক্ষিক আলোচনায় একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের অবস্থা জানতে প্রতিবারের মতো এবারও আমরা সমীক্ষা পরিচালনা করেছি।
তিনি বলেন, উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন আসলেও তাদের অনেকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে ভুগছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তারা এগিয়ে যাওয়ার জন্য তেমন অর্থনৈতিক সুযোগ খুঁজে পায়নি।
এছাড়া রানা প্লাজা থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের বিকল্প জীবিকা খুঁজতে সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে।
আইএলও এর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পৌটিয়াইনেন বলেন, এটি স্বীকার করতেই হয় যে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর পোশাক শিল্পে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এই রূপান্তরটি অন্যান্য শিল্পের জন্য একটি মডেল হিসাবে কাজ করতে পারে।
তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার একটি সংস্কৃতি তৈরি করার ওপর জোর দেয়া উচিত যেখানে শ্রমিকরা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে এবং মালিকপক্ষ সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে।
পরিশেষে সকল শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নীতি ও প্রবিধান বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব।
আলোচনায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এর যুগ্ম মহাপরিদর্শক জুলিয়া জেসমিন, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট এর সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার এর সাধারণ সম্পাদক ড. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, ডয়চে ভেলে এর সাংবাদিক হারুন উর রশীদ।
অনুষ্ঠানে রানা প্লাজার দুর্ঘটনা তুলে ধরে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীও হয়।
—-ইউএনবি
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি