নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুল টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তির সংখ্যা খুব একটা কমছে না। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে অডিট আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ। গত মার্চ শেষে যা ছাড়িয়েছে ৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশই আবার অগ্রিম আপত্তি বা গুরুতর অনিয়ম সম্পর্কিত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় থাকা ওসব প্রতিষ্ঠানে এ প্রবণতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে. নিয়মকানুন পরিপালনে ব্যত্যয় ঘটলেই অডিট আপত্তি ওঠে। অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হচ্ছে না। দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তি ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে দুর্নীতি-অনিয়ম ও অপচয় আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অডিট আপত্তি নিষ্পন্ন করতে ত্রিপক্ষীয় সভাসহ বেশ কিছু উদ্যোগ জোরদার করা হয়েছে। তারপরও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে নতুন নতুন আপত্তি ওঠায় অডিট আপত্তিতে টাকার পরিমাণ বেড়ে গেছে।
এ ছাড়া করোনার কারণে নিয়মিত সভা আয়োজন সম্ভব না হওয়াও অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তি বাড়ার অন্যতম কারণ। সূত্র জানায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ২৯ হাজার ৪৪১টি অডিট আপত্তি উঠেছে, যাতে জড়িত টাকার পরিমাণ ৩ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সর্বমোট ২৯ হাজার ৬৩৪টি অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তির বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে ৯ মাসের ব্যবধানে আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থ বেড়েছে ৫৯ হাজার কোটি টাকা বা ২৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরটিজি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), সাধারণ বীমা করপোরেশন, জীবন বীমা করপোরেশনসহ রাষ্ট্রায়ত্ত বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীনে। এ বিভাগের অধীন ২৬টি প্রতিষ্ঠানের অডিট আপত্তির হিসাব করা হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত তিন ধরনের অডিট আপত্তি থাকে।
যেসব ক্ষেত্রে অনিয়মের মাত্রা বা গুরুত্ব কম সেগুলো সাধারণ আপত্তি। আর যেসব ক্ষেত্রে অনিয়মের মাত্রা বা গুরুত্ব বেশি সেগুলো হচ্ছে অগ্রিম আপত্তি। এগুলোতে জড়িত টাকার পরিমাণ বেশি, অর্থ আত্মসাৎ বা আইনের অতিমাত্রায় বরখেলাপের অভিযোগ থাকে। এগুলো গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ। তাছাড়া আরেকটি হচ্ছে সংকলনভুক্ত আপত্তি। যেসব অগ্রিম আপত্তির ক্ষেত্রে জবাব পাঠানো হয় না বা নির্ধারিত সময়ে সঠিক জবাব পাঠানো না হলে সেসব আপত্তি বাছাই করে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) অফিসের রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় সংসদে পাঠানো হয়। এসব আপত্তি সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়।
এগুলোই ‘সংকলনভুক্ত আপত্তি’। রিপোর্টভুক্ত হওয়ার আগে খসড়া আকারে থাকলে সেগুলোকে খসড়া আপত্তি বলা হয়। সূত্র আরো জানায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ হাজার ৬৬০টি সাধারণ আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৮১ হাজার ১৮৫ কোটি, ১৮ হাজার ৪৫৬টি অগ্রিম আপত্তিতে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা, ১২৭টি খসড়া আপত্তিতে ২ হাজার ২৮৯ কোটি এবং সংকলনভুক্ত ১ হাজার ১৯৮টি আপত্তিতে জড়িত রয়েছে ৪৫ হাজার ৯১ কোটি টাকা। গত বছরের জুন শেষে ৯ হাজার ৬৩৭টি সাধারণ আপত্তিতে জড়িত টাকার পরিমাণ ৬৫ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ১৮ হাজার ৮৩৯টি অগ্রিম আপত্তিতে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩১ কোটি, ১৩৩টি খসড়া আপত্তিতে ৩ হাজার ৭২৯ কোটি এবং সংকলনভুক্ত ১ হাজার ২৫টি আপত্তির বিপরীতে ৩৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিবেদনে অডিটের সংখ্যা ও টাকার অঙ্ক উল্লেখ থাকলেও কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী পরিমাণ অনিয়মের অভিযোগ তা উল্লেখ নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বেতন, বোনাস, ইনক্রিমেন্ট নিয়ে অডিট আপত্তি ওঠে। এতে জড়িত টাকার পরিমাণও কম হয়।
তবে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের ক্ষেত্রে টাকার অঙ্ক বেড়ে যায় মূলত নানা ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে বড় অঙ্কের ঋণ প্রদান ও সে ঋণ আদায়ে ব্যর্থতার কারণে। এদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, আর্থিক খাতে অনিয়ম রোধে সরকার বদ্ধপরিকর। এজন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অডিট পরিচালনা করা হয়। তার পরও অডিট অধিদপ্তর থেকে প্রাথমিকভাবে যে আপত্তি তোলা হয়, সেটাই চূড়ান্ত নয়। পরে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে অভিযুক্ত দপ্তরের জবাবের ভিত্তিতে অনেক অডিট আপত্তির নিষ্পত্তি হয়। এসব আপত্তি নিষ্পত্তিতে বর্তমানে নিয়মিত সভার আয়োজন করা হয়। আগামীতেও তা অব্যহত থাকবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি