নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের সবচেয়ে বড় রেলস্টেশন হল রাজধানী ঢাকার কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশন দুটি। কিন্তু এগুলো পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন ও আধুনিকভাবে নির্মিত রেল স্টেশন নয়। এই দুটি ছাড়াও রেলওয়ের প্রায় সব স্টেশনই আশির দশকে তৈরি। আর বিভিন্ন জেলা সদরে বা জংশনে যে স্টেশন তা একেবারে অতুলনীয় খারাপ। এটা আছে তো ওটা নাই অবস্থা। বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন ও আধুনিকভাবে নির্মিত রেলষ্টেশন একটিও নেই। কাগজে-কলমে সারা দেশে ৩৬৮টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। কিন্তু বাস্তবে চলছে ২৭৬টি।
২০১৬ সালের হিসাবে বাংলাদেশে মোট ৪৫৮টি রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে। ২০২১ সালের হিসাবে বাংলাদেশে মোট রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে ৪৯৩টি। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ের স্টেশন, ট্রেন এবং বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণের কোনো নিজস্ব ব্যবস্থা নেই। ফলে চরম অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে হাজার হাজার কিলোমিটার রেলপথ, ৪৯৩টি স্টেশন ও বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবন। সারাদেশে ৩৬৮টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। ওসব ট্রেনের গুটি কয়েকটির মধ্যে ফায়ার এক্সটিংগুইসার থাকলেও তার অধিকাংশই অকেজো। অনেকটির মেয়াদ শেষ। নিয়মিত সার্ভিসিং করা হয় না। অথচ ওসব ট্রেনে প্রতিদিন প্রায় ৩ লাখ যাত্রী অগ্নিঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।
দুর্ঘটনা লাইনচ্যুত যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা কারণে ট্রেনে রেললাইনে ইঞ্জিনে কম্পার্টমেন্টে কখনও স্টেশনেও আগুনের ঘটনা ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্টেশনগুলোতে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা না থাকায় সম্পূর্ণ ফায়ার সার্ভিসের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু স্টেশনগুলোতে ফায়ার সার্ভিস প্রবেশের প্যাসেজ নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানীর কমলাপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ প্রায় সব ক’টি বড় বড় রেলওয়ে স্টেশনেই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। বারবার পুড়েছে স্টেশন, ট্রেন।
চলন্ত ট্রেনের যাত্রীবাহী বগি-ইঞ্জিনেও ছোটখাটো অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। কারণ ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। আর কোচের ৩৫ বছর। রেলের হিসাবেই ৬৭ শতাংশ ইঞ্জিন এবং ৪৭ শতাংশ কোচ আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে। ৯৫টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছে স্বাধীনতার আগে। এগুলোর কোনো কোনোটির বয়স ৬৬ বছর পর্যন্ত।
রাজনৈতিক সহিংসতা এবং নানা কারণে রেলওয়েতে ব্যাপক অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। সূত্র মতে, চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে গণপরিবহনের পাশাপাশি আন্দোলনকারীরা ট্রেনকেও টার্গেটে পরিণত করেছে। ট্রেনে আগুন দেওয়া, রেললাইন উপড়ে ফেলা, স্টেশনে ককটেল হামলা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই তাদের লক্ষ্য। তথ্য বলছে, ১৬ নভেম্বর ভোর রাতে টাঙ্গাইল রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কমিউটার ট্রেনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রেনের তিনটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনায় টাঙ্গাইল রেলস্টেশন সহকারী মাস্টার তরিকুল ইসলাম বাদী হয়ে রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে মামলা দায়ের করেন। এবং ১৮ নভেম্বর দিবাগত রাতে সরিষাবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন থেকে তারাকান্দি যাওয়ার সময় আন্তঃনগর যমুনা এক্সপ্রেসে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল দুর্বৃত্ত।
এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন সরিষাবাড়ী রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী মাস্টার আবদুস সালাম। অগ্নিকা- রেলওয়ে পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় ফায়ার সার্ভিসের ওপর। জেলা পর্যায়ে এবং কয়েকটি উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস আছে। দূরত্ব ভেদে আগুন লাগলে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছতে পৌঁছতেই বড় ধরনের ক্ষতি হয়েই যায়। রেলের নিজস্ব আধুনিক অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমত, এমন মন্তব্য একজন প্রকৌশলীর। সূত্র জানায়, দেশে নতুন তৈরি করা রেল স্টেশন ও রিমডেলিং স্টেশনগুলোতে অগ্নিনির্বাপণে যথাযথ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তাছাড়া শুধু বড় স্টেশনগুলো নয়, ছোট স্টেশনগুলোতেও নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। স্টেশনগুলোর চারপাশে যথাযথ বেড়া না থাকায় ইচ্ছেমতো সাধারণ মানুষ স্টেশন হয়ে চলাচল করে।
নাশকতাকারীরা যে কোনো সময় এ সুযোগটি ব্যবহার করে বড় ধরনের নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে। একবিংশ শতকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে রেল যোগাযোগকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে রেলের সম্পদ রক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়। কিন্তু এদেশে তা দারুণভাবে অনুপস্থিত। তাছাড়া প্রতিদিন রেলে হাজার হাজার যাত্রী চলাচল করে। ট্রেনে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখনো তা নিশ্চিত করা যায়নি। সূত্র আরো জানায়, রেলওয়েতে যে কোনো নাশকতা রোধে পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা জরুরি হলেও রেলওয়েতে তা নেই। প্রথমত সংস্থাটিতে লোকবলের অভাব রয়েছে। বর্তমানে রেলওয়ের থানাগুলোতেও আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই।
অথচ স্টেশন, প্রশাসনিক ভবনসহ প্রতিটি ট্রেনেই অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষ করে স্টেশন ভবন ও প্লাটফর্মের প্রতিটি পিলার দেয়ালে ফায়ার এক্সটিংগুইসার লাগানো দরকার। প্রতিদিন স্টেশনগুলো দিয়ে হাজার হাজার যাত্রীসাধারণ চলাচল করছে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। একটা সময় যখন স্টিম ইঞ্জিনে (কয়লার আগুন ও পানিতে) ট্রেন চলাচল করত তখন বড় ও মাঝারি স্টেশনগুলোতে ইঞ্জিনে পানি নেয়ার ওভারহেড ব্যবস্থা ছিল। স্টেশনে এবং স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনে কোনো কারণে আগুন লাগলে এই পানি আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার হতো।
বর্তমানে সবই ডিজেল ইঞ্জিন হওয়ায় স্টেশনে থেমে পানি নেয়ার প্রয়োজন হয় না। স্টেশনে পানির এই আঁধার আর নেই। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পর যে বড় ইঁদারায় রাখা হতো তাও ভরাট হয়ে গেছে। স্টেশনে আগুন নেভানোর পানি স্টোরেজেও ব্যবস্থাও নেই। সব মিলিয়ে রেলগাড়ি ও স্টেশন অগ্নি ঝুঁকিতে রয়ে গেছে। এদিকে নাশকতা রোধে রেলের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও কম। এ বিষয়ে রেলওয়ে সহকারী পুলিশ সুপার ঊর্মি দেব আজকের পত্রিকাকে জানান, ‘প্রতিটি ট্রেনে তিনজন করে পুলিশ মোতায়েনের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু লোকবল স্বল্পতার কারণে তাও সম্ভব হচ্ছে না। এখন ট্রেনে নাশকতা রোধে আমরা অতিরিক্ত পুলিশের চাহিদা চেয়েছি। শিগগিরই প্রতিটি ট্রেনে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করতে পারব।’
রেলের ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, আগুন নেভানোর আধুনিক ব্যবস্থা থাকার বিষয়টি নিয়ে ওপর মহলে আলোচনা চলছে। একই প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, পুরো রেলওয়েতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ রয়েছে। শুধু রেলওয়ে স্টেশন, প্রশাসনিক ভবনই নয়, যে কোনো সময় ট্রেনগুলোতেও আগুন লাগতে পারে। কর্তৃপক্ষ দ্রুত সময়ের মধ্যে পুরো রেলওয়েতে অগ্নিনির্বাপণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি