নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশ রেলওয়ের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ফলে লাফিয়ে বাড়ছে লোকসান। প্রতিবছর আয়ের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আয় করলেও ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিগত ১৩ বছরে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে এবং আরো প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। নতুন রেলপথ, রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ, অত্যাধুনিক লোকোমোটিভসহ (ইঞ্জিন) ১৪২টি নতুন ট্রেন রেলবহরে যুক্ত হয়েছে। বিদ্যমান ৪৪টি ট্রেনের রুট বর্ধিত করা হয়েছে। কিন্তু এত উন্নয়নেও রেল লোকসান কমাতে পারছে না। বরং প্রতিবছরই লোকসান বেড়েই চলেছে। আর ক্রমাগত লোকসানের লাগাম টানতে ট্রেনের ভাড়া দুবার বাড়িয়েও কাজ হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে আবারো ভাড়া বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে রেল।
সূত্র জানায়, ট্রেনে প্রতিদিন আসনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ যাত্রী বিনা টিকিটে ভ্রমণ করলেও তা রোধের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বিগত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেল ৬২৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা আয় করে আর ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করে। ২০১১-১২ অর্থবছরে আয় ৬০০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ব্যয় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয় ৯৪৬ লাখ টাকা এবং ব্যয় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় ১ হাজার ১০০ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ব্যয় ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে রেল ভাড়া আবারো বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ওই লক্ষ্যে সড়ক যান, নৌযানের সঙ্গে ট্রেনের বর্তমান ভাড়া সমন্বয় করতে সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে মালামাল পরিবহণের ক্ষেত্রে বর্তমান ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া নির্ধারণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। রেলে মালামাল পরিবহণের ক্ষেত্রে ভাড়া দ্বিগুণ বাড়ানো হলেও সড়কপথের চেয়ে অন্তত ৫-৭ গুণ কম ভাড়া থাকবে।
সূত্র আরো জানায়, রেলের আন্তঃনগর ট্রেনের ক্ষেত্রে গড়ে ৬৯ শতাংশ আসন সংখ্যা অবিক্রীত থেকে যায়। অথচ এমন কোনো আন্তঃনগর ট্রেন নেই যেগুলোতে আসনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি যাত্রী চলাচল করছে না। দেশে আন্তঃনগর ট্রেনের উদ্বোধনের সময়ই ২-৩টি বিরতি থাকে। পরে রাজনৈতিক কারণে অতিরিক্ত ৭-৮টি স্টেশনে বিরতি দিতে হয়। ১০৫টি আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে মাত্র ২টি ট্রেন বিরতিহীন চলাচল করে। বর্তমানে ১০৩টি আন্তঃনগর ট্রেন গড়ে ৭ থেকে ১১টি স্টেশনে বিরতি দেয়। মধ্যের স্টেশনগুলোতে আসনসংখ্যা বরাদ্দ থাকলেও মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়। আবার ওই সংখ্যক টিকিট মধ্যবর্তী স্টেশনগুলোতে বিক্রি হলেও পরবর্তী স্টেশনগুলোতে আসনসংখ্যা পুরোপুরিই খালি যায়। ট্রেন পরিচালনা ও স্টেশনগুলোর বেষ্টনী-নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা গেলে শুধু টিকিট বিক্রি থেকে বছরে দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা আয় সম্ভব। বর্তমানে সেখানে মাত্র ৬৫০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা আয় হচ্ছে। রেলওয়ের হিসাবে কোনো স্টেশনে মেইল, লোকাল বা আন্তঃনগর ট্রেন থামাতে গড়ে খরচ হয় ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। জ্বালানি, বিভিন্ন পরিকাঠামো, সিগন্যালিংসহ নানা খরচ হয়। বর্তমানে ১২৩টি স্টেশন বন্ধ। তাছাড়া নতুন ৪টি স্টেশন বছরের পর বছর ধরে বন্ধ। বন্ধ স্টেশনগুলো চালু না করে কম গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্টেশনে মেইল ও আন্তঃনগর ট্রেনের লাগাতার বিরতি দেয়া হচ্ছে। তাতে আয় না রেলের বেড়ে ব্যয় বাড়ছে।
এদিকে রেল সংশ্লিষ্টদের মতে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকা-যশোর, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার, খুলনা-মোংলাসহ বেশ কয়েকটি নতুন রেলপথ লাইন সম্পূর্ণ হবে। কিন্তু ওসব লাইনে যাত্রী পরিবহণ লাভজনক হবে না। তবে মালামাল পরিবহণে সড়কপথের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলে রেল কিছুটা হলেও লাভের মুখ দেখবে। ঢাকা-যশোর রেলপথ সিঙ্গেল ব্রডগেজে তৈরি হচ্ছে। অথচ ওই প্রকল্পে ডাবল ব্রডগেজ লাইন নির্মাণ হলে আয় বাড়তো। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০টি মালবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হতো। সিঙ্গেল লাইন হওয়ায় ২০ থেকে ২৫টির মতো ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হবে। ফলে ব্যয় বাড়লেও আয় দিন দিন আরো কমবে।
অন্যদিকে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, গত এক যুগে রেলে উন্নয়ন হচ্ছে বেশ। কিন্তু ওসব উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না থাকায় সুফল মিলছে না। নতুন ট্রেন, নতুন রেলপথ, স্টেশন নির্মাণ হলেও গতি আসছে না। কারণ যাত্রী ও মালামাল পরিবহণে কোনো পরিকল্পনা নেই। যতো পরিকল্পনা নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। ফলে উন্নয়ন হলেও রেলের আয় না বেড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ব্যয় বাড়ছে। পাশাপাশি রেল সংশ্লিষ্টদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে বর্তমান অবস্থারও কোনো উন্নতি হবে না।
অন্যদিকে ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, বছরের পর বছর ধরে রেল লোকসান দিয়ে আসছে। পৃথিবীর কোথাও এত কম ভাড়ায় ট্রেন চলে না। একজন যাত্রী পরিবহণে প্রতি কিলোমিটারে ৩ টাকা ৬০ পয়সা খরচ হয়। আর ৬০ পয়সার চেয়েও কম আয় হয়। আর মালবাহী ট্রেনে খরচের পাল্লা আকাশচুম্বী। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া পৌনে ৩ টাকার মতো, আর ব্যয় হয় ১০ টাকারও বেশি। সরকার ক্রমাগত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। নতুন ট্রেন, রেলপথসহ ব্যাপক উন্নয়ন করা হচ্ছে। ভাড়া বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে মালামাল পরিবহণে ভাড়া বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই।
আরও পড়ুন
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
কমতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামের নদীর পানি, ভাঙন আতঙ্কে মানুষ
দিনাজপুরে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় নিহত ২