নিজস্ব প্রতিবেদক:
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার পরও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি অস্থির ছিল বিগত দিনগুলোতে। নানা কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো দিন দিন অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। প্রতিনিয়ত হত্যা, মানব পাচার, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, গুম, অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবী ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে সেখানে। নিয়মিত অপরাধ সংগঠিত হলেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে অপরাধীরা। এরইমধ্যে ক্যাম্পের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে নির্বিঘ্নে বের হয়ে কক্সবাজারের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। কেউ কেউ কাজের সন্ধানে থাকলেও এসব রোহিঙ্গাদের অনেকে পর্যটন এলাকায় চুরি, ছিনতাই, অপহরণসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। এতে নিরাপত্তার প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে কক্সবাজারসহ পুরো উপকূলীয় এলাকা।
একদিকে রোহিঙ্গারা শরণার্থীশিবিরে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজারে মাদক, অস্ত্র ব্যবসা এবং মানব পাচারের মতো গুরুতর অপরাধ বাড়ছে। এতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, অস্ত্র, মাদক এবং খুনসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা করছেন না রোহিঙ্গারা। গত চার মাসে ১১ ধরনের অপরাধের ঘটনায় ৫৯১টি মামলা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবহিত করেছি।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, নানা কারণে রোহিঙ্গা এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। প্রত্যাবাসন ছাড়া রোহিঙ্গা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান কঠিন। প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক সহিংসতা বিশেষ করে সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে মাত্র ৩১ হাজার ৪৩৯ জনকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। বাকিরা কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এদিকে শরণার্থীশিবিরের রোহিঙ্গাদের অনেকেই অবৈধ পথে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮-২২ সালে ৮ হাজার ৩১২ রোহিঙ্গা শরণার্থী সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ৫৮৯ জনের সলিলসমাধি হয়েছে। নিখোঁজও হয়েছেন অনেকে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৈরি পোশাকশিল্পের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের বেশ ভালো অবস্থান রয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যদি মানব পাচারকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়, তাহলে বৈশ্বিক বাজারে আমাদের সেই অবস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) ১০টি দুর্বৃত্ত দল ও সশস্ত্র গুষ্টি সক্রিয় রয়েছে বলে জানা যায়। ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২১-২২ সালে সংগঠিত ২২২টি অগ্নিকা-ের ঘটনার মধ্যে ৬০টি ছিল নাশকতামূলক। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, অস্ত্র, মাদক পাচার, চোরাচালান সহ নানা অপরাধে জড়িত। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উপকূল থেকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়ায় রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশীদের মানবপাচার এখন একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠেছে।
মিয়ানমার থেকে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে অবৈধভাবে মাদক ও ইয়াবা পাচার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও সীমান্তের নিরাপত্তাহীনতা পুরো দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জন্য নিরাপত্তার হুমকি তৈরি করছে। এদিকে বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে রোহিঙ্গাদের কারণে নিরাপত্তা শংকার বিষয়টি প্রতিনিয়িত সামনে আনছেন কক্সবাজারের স্থানীয়রা। ক্যাম্প ছেড়ে কক্সবাজার শহর ও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকারও করেছে এপিবিএন। এপিবিএনের একাধিক চেকপোস্ট থাকার পরও রোহিঙ্গাদের নির্বিঘেœ বের হওয়ার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। এজন্য নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের উদাসিনতাকে দায়ী করেছেন তারা।
কক্সবাজার শহরে রোহিঙ্গা কিশোর ও যুবকদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতির কথা স্বীকার করে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত তারা। জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, অস্ত্র, মাদক এবং খুনসহ ১১ অপরাধের ঘটনায় গেলো চার মাসে ৫৯১টি মামলা হয়েছে রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে। যেখানে আসামি করা হয়েছে এক হাজার ৭৬২ জনকে। মোট মামলার ২৬২টি শুধু মাদক সংক্রান্ত মামলা। হত্যা মামলা রয়েছে ৫৫টি। কক্সবাজার জেলা আদালত সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে নানা অপরাধেও জড়াচ্ছেন। সম্প্রতি আদালতে সবচেয়ে বেশি মামলা হচ্ছে রোহিঙ্গা অপরাধের।
সূত্রমতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, পুলিশের ওপর হামলা, হত্যা ও মানব পাচারসহ নানা অপরাধে ২ হাজার ৪৩৮টি বিভিন্ন ধরনের মামলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা গেলে এবং শৃঙ্খলাবাহিনী আরও একটু সচেতন হলে অপরাধের মাত্রা কমে আসবে। জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৬৪টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে চলতি বছরের এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৬১টি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৭৪ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ এসব অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে এবং তাদের কারণে স্থানীয়রাও নিরাপত্তা হুমকিতে রয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরগুলোতে সাড়ে ১২ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা বসবাস করছে। ক্যাম্প এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে ও এই সমস্যা সমাধান করা বেশ কষ্টসাধ্য। ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মানবিক সেবায় দেশ-বিদেশের শতাধিক সংস্থার ২০ হাজারের ও বেশি কর্মী কাজ করছে। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হওয়ার কারণে ক্যাম্পে কাজ করতে যাওয়া এনজিও-আইএনজিওর কর্মীরা উদ্বিগ্ন এবং তাঁদের অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এসব কারণে বেশ কিছু এনজিও ক্যাম্পগুলোতে তাঁদের সেবা কার্যক্রম সীমিত রেখেছে এবং কয়েকটি এনজিও তাদের কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে যা আশঙ্কাজনক।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আর ও অনেক কিছু করার আছে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোর ওপর থেকে চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে, সবমিলিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই স্থানান্তর ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশের একার পক্ষে এই ব্যয়বহন করা কষ্টসাধ্য। ভাসান চরের খালি জায়গাতে নতুন ক্যাম্প নির্মাণ করে দ্রুততম সময়ে যত বেশি রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর যাবে ততই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
রোহিঙ্গাদেরকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নিতে বন্ধুরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশ সরকার পরিবহন খরচ বহন করা এবং রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আরও নতুন অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা চেয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য বহুমাত্রিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত হুমকি সৃষ্টি করছে, সামনের দিনগুলোতে তা আরো জটিল হবে। এদিকে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান সুয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। উগান্ডায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের (ন্যাম) সাইডলাইনে তিনি এই বৈঠক করেন। বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি রহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম