April 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, December 13th, 2021, 8:38 pm

র‌্যাব কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা: নানা মহলে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

প্রতীকী ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর। এই বিষয়টি নিয়ে এখন দেশে বেশ আলোচনা সমালোচনা চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
মার্কিন অর্থ দফতরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ খবর প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের এই দিনে মার্কিন অর্থ দফতরের ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস (ওএফএসি) বিভিন্ন দেশের মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ জন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে – যারা মানবাধিকার লংঘন এবং নিপীড়নের সাথে সংশ্লিষ্ট। এই তালিকাভুক্তদের অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশের র‌্যাব ও এর ছয়জন কর্মকর্তা।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত ছয় জন কর্মকর্তা হলেন– চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন (র‌্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক), বেনজির আহমেদ (সাবেক র‌্যাব মহাপরিচালক, জানুয়ারি ২০১৫-এপ্রিল ২০২০), খান মোহাম্মদ আজাদ (বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স), তোফায়েল মুস্তাফা সরওয়ার (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, জুন ২০১৯-মার্চ ২০২১), মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, সেপ্টেম্বর ২০১৮-জুন২০১৯), এবং মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, এপ্রিল-২০১৬-সেপ্টেম্বর ২০১৮)।
এতে বলা হয়, গুরুতর মানবাধিকার লংঘনে জড়িত থাকার জন্য বেনজির আহমেদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর – যার ফলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য হবেন।
বিজ্ঞপ্তিটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে র‌্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, ৬০০-রও বেশি লোকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী।বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চীনের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের কারণে।
বিজ্ঞপ্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি ওয়ালি আডেয়েমোর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়, এ পদক্ষেপ একটি বার্তা দিচ্ছে যে যারা নিপীড়ন চালাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র কথা বলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে র‌্যাবের যে কার্যক্রম, তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ ও বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারকে তলব করা হয়েছে। শুক্রবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ওই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাংলাদেশের অসন্তোষের কথা জানান। বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।
শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, পররাষ্ট্র সচিব এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে দুই দেশের বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় আয়োজিত আলোচনার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে উল্লেখ করার বিষয়টি নজরে আনেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্র আগে আলোচনা না করেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। সরকারের একটি সংস্থা সন্ত্রাসবাদ, মাদক পাচার ও অন্যান্য ঘৃণ্য আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনের সামনের সারিতে রয়েছে। এ বিষয়গুলোকে ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারগুলোরও অগ্রাধিকারের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন একটি সংস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত পররাষ্ট্র সচিব দুঃখজনক হিসেবে অভিহিত করেন।
পররাষ্ট্র সচিব এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেন, র‌্যাবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে শুধু মার্কিন প্রশাসনকেই নয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদকেও তথ্য-উপাত্তের পাশাপাশি ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে একাধিকবার জানানো হয়েছে। এর পরও যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপ দুঃখজনক। অভিযোগের বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই শুধু স্থানীয় পর্যায়ে ঘটে যাওয়া সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা যেসব দেশে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’-এর মতো ভয়াবহ আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এমন কিছু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তটা দুঃখজনক।
আর্ল মিলার বাংলাদেশ সরকারের উদ্বেগের বিষয়টিকে আমলে নিয়ে তা ওয়াশিংটনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরার আশ্বাস দিয়েছেন। পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনার সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ অভিমতও দিয়েছেন যে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার বিদ্যমান কাঠামো এবং উচ্চপর্যায়ের সফর বিনিময়ের মধ্য দিয়ে চমৎকার ও বহুমাত্রিক এ সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করার সুযোগ রয়েছে। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মার্কিন সরকারের ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকতে চাওয়ার সদিচ্ছার বিষয়টিও আর্ল মিলার উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘বিষয়টি দুঃখজনক। যুক্তরাষ্ট্রের এ অভিযোগ কল্পনাপ্রসূত।’
রোববার রাজধানীতে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক কর্মশালার উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেনি।
অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান ব্যবস্থায় কেউ ইচ্ছে করে ক্রসফায়ার বা গুলি করতে পারেন না।
শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ওয়াসা ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার একটা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এ প্রতিবেদন আমার টেবিলে এখনো আসেনি। এটা আমাকে দেখতে হবে, তারা কেন, কীভাবে, কী কারণে এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেটা না দেখে আমি পুরো মন্তব্য করতে পারব না।আমাদের দেশে যতগুলোই ঘটনা ঘটেছে সবগুলোর একটা জুডিশিয়ারি ইনকোয়্যারি হয়। একজন ম্যাজিস্ট্রেট সেটা যাচাই করেন যে অ্যাকসিডেন্টটা হলো, তার পেছনে যথাযথ কারণ ছিল কিনা। নাকি গাফিলতি ছিল। আমরা যেখানে কোনো গাফিলতি পাই, সেখানে তার বিরুদ্ধে মামলা চালু হয়ে যায়। আর গাফিলতি না থাকলে সেখানে ক্লোজ হয়। তিনি বলেন, আমাদের সিস্টেম খুব সুন্দর। কাজেই এ সিস্টেমে কেউ ইচ্ছে করে ক্রসফায়ার বা ইচ্ছে করে গুলি করতে পারেন না। এসব ঘটনার পেছনে যথাযথ কারণ ছিল বলে বিগত দিনে প্রতীয়মান হয়েছে। এসব ঘটনা শুধু আমাদের দেশে নয়, সব দেশেই চলছে বা চালু আছে।
এদিকে, র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শনিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবিতে শীর্ষক আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন।
মহাসচিব বলেন, আমরা এতদিন ধরে বলে আসছি, মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। আমরা বলে আসছি, এই সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে, পুলিশকে ব্যবহার করছে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে মানুষকে হত্যা করছে। আজকে প্রমাণিত হয়েছে। তবে আমরা দেখতে চাই যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে। এটা আমাদের জন্য লজ্জা। সুতরাং জনগণের কাছে এর জবাব তো দিতেই হবে।