জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মনু নদের ওপর কুলাউড়া-পৃথিমপাশা-হাজীপুর-শরীফপুর সড়কে ‘রাজাপুর সেতু’ নির্মাণের কাজ প্রায় দুই বছর আগে শেষ হয়েছে। কিন্তু সেতুর দুই পাশের সংযোগ সড়কের কাজ শেষ না হওয়াতে এ সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়নি। এ অবস্থায় উঁচু সেতুর দুই পাশে মই ব্যবহার করে স্থানীয় লোকজন জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছিলেন। পরবর্তীতে মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে নিউ নেশনসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের।
পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সিনিয়র এক কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ও সওজে’র জেলা নির্বাহী প্রকৌশলীকে দেয়া হয়। এরপর তড়িঘড়ি করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে চাপপ্রয়োগ করে সেতুর দুই পাশের এপ্রোচ সড়কে মানুষের সাময়িক চলাচলের উপযোগী করে বালু দিয়ে ভরাট করায় জেলা প্রশাসন ও জেলা সড়ক বিভাগ। এরপর থেকে স্থানীয় লোকজন কোনোমতে সেতু দিয়ে পারাপার করছেন। এ প্রকল্পের মেয়াদে কাজ প্রায় ২ বছর ৯ মাসে এখন পর্যন্ত হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। এতেই সরকারের এত বড় উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গড়িমসির ফলে দীর্ঘায়িত হচ্ছে এ সেতু প্রকল্পের কাজ।
সওজ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার ও স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের রাজাপুর এলাকায় মনু নদের পাড়ে একটি খেয়াঘাট ছিল। নদের বিপরীত পাশে হাজীপুর ও শরীফপুর ইউনিয়ন পড়েছে। এসব এলাকার লোকজন রাজাপুরের খেয়াঘাট দিয়ে প্রতিদিন নৌকায় করে নদ পার হয়ে পৃথিমপাশাসহ উপজেলা সদরে বিভিন্ন কাজে আসা-যাওয়া করতেন। এতে দীর্ঘ দিন ধরে তাঁরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছিলেন। পৃথিমপাশা, হাজীপুর ও শরীফপুর ইউনিয়নের মানুষ সরকারের কাছে দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে রাজাপুর সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন হয়।
পরে সওজ অধিদপ্তর মনু নদের ওপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পে ‘কুলাউড়া-পৃথিমপাশা-হাজীপুর-শরীফপুর সড়কের ১৪তম কিলোমিটারে ২ শত ৩২ দশমিক ৯৪ মিটার পিসি গার্ডার সেতু, সাড়ে ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও জমি অধিগ্রহণ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৯ কোটি ১৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। পরবর্তীতে ৩৪ কোটি টাকায় ব্যয়ে সেতু নির্মাণে ‘জন্মভূমি-ওয়াহিদুজ্জামান-নির্মিতি’ নামের সিলেটের যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ নির্মাণ কাজ ২০২১ সালের জুন মাসে শেষ করে। ২০২০ সালে কার্যাদেশ পাওয়া প্রায় ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুর দুই পাশে সাড়ে ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ পায় ‘জামিল-ইকবাল’ নামের সিলেটের আরেকটি যৌথ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। কাজের মেয়াদ ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। বর্তমানে কাজের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানা হয়েছে।
স্থানীয় পৃথিমপাশা ইউনিয়নের গজভাগ গ্রামের বাসিন্দা তোয়াহিদ মিয়া, মোবারক আলী, মবশ্বির আলী, ইসমাইল আলী, জাহানারা বেগম, তোরাব আলী, ইসহাক মিয়া, পিয়ারা বেগম, বিনয় চন্দ্র, গোবিন্দ্র, রঞ্জু, রিপন মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে আমরা এই এলাকায় বসবাস করে আসছি। আমাদের জমির দলিল রয়েছে, খারিজ করে খাজনাও দেয়া হয়েছে। আমরা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জমির ক্ষতিপূরণের জন্য অধিগ্রহণের শুরুতেই আবেদন করেছি কিন্তু অদ্যাবদি কোন টাকা পাইনি।
তারা অভিযোগ করে বলেন, আমাদের জমির সকল কাগজপত্র জমা দিলেও ভূমি অধিগ্রহণের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, শুধু নিজের মালিকানার দলিল থাকলে হবে না, পূর্ববর্তী কয়েক ভায়ার দলিল লাগবে। তাদের এই তথ্য চাওয়াতে আমরা এখন বিপাকে পড়েছি। আমাদের নিজের জমির দলিল ছাড়া পূর্ববর্তী দলিল সংগ্রহে নেই তাই বলে কি আমরা জমির ক্ষতিপূরণ পাবোনা। অহেতুক ভূমি অধিগ্রহণের কর্মকর্তারা আমাদের কাগজ নিয়ে গড়িমসি করছেন। ক্ষতিপূরণ না পেলে আমরা কেন জমি দিব। জমি দিলে আমাদের বসতবাড়ি থাকবে না। আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো। তাই আমরা কাজ করতে আপত্তি দিয়েছি।
শরীফপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ খলিলুর রহমান ও হাজীপুর ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বক্স বলেন, সেতুটি চালু হলে শরীফপুর-হাজীপুর ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ কম সময়ে উপজেলা সদরে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। দীর্ঘদিন থেকে কমলগঞ্জ উপজেলা হয়ে প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার সড়ক ঘুরে কুলাউড়া শহরে যাতায়াতে সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা সূত্রে জানা যায়, কুলাউড়া-পৃথিমপাশা-হাজীপুর-শরীফপুর (রাজাপুর সেতু) পার্ট-১ এ গত ৯ ফেব্রুয়ারি পৃথিমপাশা ইউনিয়নের রাজনগর ও ইউসুফ সদর মৌজায় দখল হস্তান্তর করা হয় সওজ’কে। সওজ থেকে প্রাপ্ত ৮ কোটি ১১ লক্ষ থেকে ৮৫টি পরিবারকে মোট ৫ কোটি ৩৩ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। পার্ট-২ এ গত ১১ ডিসেম্বর হাজীপুর ইউনিয়নের উপরিভাগ ও সুখনাভী মৌজায় সওজকে দখল হস্তান্তর করা হয়। প্রাপ্ত ৩ কোটি ১০ লক্ষ টাকা থেকে স্থানীয় ৮১ পরিবারকে মোট ১ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। পার্ট-৩ এ শরীফপুর ইউনিয়নের দত্তগ্রাম,মনোহরপুর ও চাতলাপুর মৌজায় অধিগ্রহণের কাজ চুড়ান্ত অনুমোদন হলে প্রাক্কলন প্রস্তুত শেষে জমির মালিকদের ক্ষতিপূরনের টাকা হস্তান্তর কাজ চলমান আছে।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘জামিল-ইকবাল’ এর প্রজেক্ট ম্যানেজার আকাইদ হোসাইন বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কাজে ধীরগতি হয়েছে এটা স্বীকার করছি। তাছাড়া চলতি বছরের শুরুতে আংশিক জমির দখল বুঝে পেয়েছি জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে। কিন্তু স্থানীয় ভূমি মালিক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টাকা না পাওয়ায় তারা কাজ করতে বাঁধা দিচ্ছেন। কাজ করতে সব ধরণের সরঞ্জাম প্রস্তুত আছে।
সওজ অধিদপ্তরের কুলাউড়া সড়ক বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শাহ আলম বলেন, রাজাপুর সেতুর সংযোগ সড়কে ২০টি কালভার্টের মধ্যে নয়টি ইতিমধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেছে। জমি অধিগ্রহণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করতে গেলে সংযোগ সড়কের পৃথিমপাশা অংশে স্থানীয়দের বাঁধায় কাজ শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি