April 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, October 31st, 2021, 12:51 pm

শনির দশা কাটছেই না এম এ মান্নান ফ্লাইওভারের

নিজস্ব প্রতিবেদক:

শনির দশা যেন কাটছেই না চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট এমএ মান্নান ফ্লাইওভারের। যানজট নিরসনের জন্য নির্মাণ সাধন চট্টগ্রামের প্রথম এই ফ্লাইওভার উদ্বোধনের আগেই গার্ডার ধসে ১৪ জন প্রাণ হারিয়েছিল। তৈরি হয়ে যাওয়ার পর ২০১৭ সালে একটি র‌্যাম্প নামানো হয়, যা নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদরা তখনই বিরোধিতা করেছিলেন। বহদ্দারহাট থেকে টার্মিনালমুখী সেই র‌্যাম্পের দুটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। সোমবার রাতে ফাটল দেখে কয়েকজন ফেসবুকে ছবি শেয়ার করলে তা ভাইরাল হয়। এরপর স্থানীয় পুলিশ এসে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে টার্মিনালমুখী অংশটির দুদিকেই যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। রাত থেকেই ওই এলাকায় উৎসুক মানুষ ভিড় করে। হালকা গাড়ি চলাচলের জন্য নামানো র‌্যাম্পটিতে ভারি গাড়ি চলায় এই ফাটল হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত এ ফ্লাইওভারটি অপরিকল্পিত এবং একইভাবে ত্রুটিপূর্ণ বলেও অভিমত রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
তারা বলছেন, ত্রুটি ও নানা নালিশ নিয়ে নির্মিত ফ্লাইওভারে কোনো ধরনের সমীক্ষা এবং সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই নির্মাণ সাধন হয়েছিল র‌্যাম্পটি। এর ওপর দিয়ে ভারি যানবাহনও চলাচল করেছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। আগেও ফ্লাইওভারটির নির্মাণ চলাকালেই দুবার বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
দেশে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজে অদক্ষতা ও নকশার ত্রুটির এটিই প্রথম নালিশ নয়। এর সামনে ফ্লাইওভারে এ ধরনের ত্রুটি দেখা দিয়েছিল রাজধানী ঢাকায়ও। ২০১১ সালে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের তিনটি ফ্ল্যাপ দেবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই সময় ফ্লাইওভারটি বন্ধ রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন হয়েছিল। অন্যদিকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারেও রয়েছে নকশাগত ত্রুটি। বর্তমানে এ ত্রুটি নিয়েই ফ্লাইওভারটি দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। দুর্ঘটনা এড়াতে সতর্কতা হিসেবে রাখা হয়েছে সিগনাল বাতির ব্যবস্থা।
জানা যায়, মূল ফ্লাইওভারটি তৈরি করেছে পারিশা এন্টারপ্রাইজ ও মীর আক্তার এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে ২০১৬ সালে শুরু হয়ে ২০১৭ সালে শেষ হয় আরাকান রোডের সঙ্গে সংযোগকারী র‌্যাম্পের কাজ। র‌্যাম্পটি তৈরি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। র‌্যাম্পটি নির্মাণের ব্যয় সম্পর্কে সিডিএ বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কোনো ধরনের তথ্য জানাতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, র‌্যাম্পটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি টাকার সামান্য বেশি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী মঙ্গলবার দুপুরে ফ্লাইওভার পরিদর্শনে যান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, কাজটি করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন শাসনকর্তা (চউক)। আমরা তাদের চিঠি দেব এ বিষয়ে জরুরী পদক্ষেপ নিতে। যেকোন সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এখানে। আগেও এখানে গার্ডার পড়ে প্রাণহানির ঘটেছে। আমরা ওই অংশে বর্তমানে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা এ বিষয়ে সচেতন। এটার বিষয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি চেয়ারম্যানের সঙ্গে আজকেই উক্তি বলব। মেয়র আরও জানান, তদন্তের সামনে এর দায়ী কে বলা যাবে না। তদন্ত করে বলা যাবে এর নির্মাণ ত্রুটি অথবা এ বিষয়ে গাফিলতি রয়েছে কিনা। মূল নক্সার সঙ্গে এই র‌্যাম্পটি ছিল না উল্লেখ করে মেয়র বলেন, পরবর্তীতে এটি যুক্ত সাধন হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে চউক। র‌্যাম্পটি নির্মাণ করেছিল ম্যাক্স। ব্যবস্থা নেবে চউক। তবে ফাটল দেখে মনে হচ্ছে নির্মাণে ত্রুটি ছিল। আমাদের প্রকৌশলীরা এ বিষয়ে ভাল জানেন। মেয়র আরও বলেন, যেভাবে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে আমি নিজেও দেখে হতবাক হয়েছি।
স্থানীয়রা বলছেন, ফ্লাইওভারটি নির্মাণের সময় দুবার বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে নকশার বাইরে গিয়ে নতুন করে আরাকান রোডমুখী র‌্যাম্পটি নির্মাণ সাধন হয়েছে। অন্যদিকে র‌্যাম্পটির প্রস্থ সাড়ে ছয় মিটার হলেও এরপর দিয়ে বড় বড় লরি ট্রাক চলাচল করে। ফ্লাইওভারটি বর্তমানে বড় ধরনের ঝুঁকিতে আছে। মাঝে মাঝে ভারী ভারী লরি-ট্রাক চলাচলের সময়ে ফ্লাইওভারটিতে কম্পন শুরু হলেও বিষয়টিকে তেমন একটা আমলে নেয়া হয়নি।
ভারী এসব যানবাহন চলাচলকেই র‌্যাম্পের পিলারে ফাটলের জন্য দায়ী করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মনির হোসেনের ভাষ্য, বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় যে র‌্যাম্পটি যার ক্ষতি হয়েছে এমন হয়েছে সেটি মূল নকশায় ছিল না। পরে প্রকল্পে যুক্ত করে আমরা কাজটি শেষ করেছি। ফ্লাইওভারটির র‌্যাম্পের নকশা সিডিএ আমাদের যেভাবে দিয়েছে আমরা সেভাবে পেশা করেছি। নকশায় কোনো ত্রুটি ছিল যেহেতু সেটা সিডিএ ভালোভাবে বলতে পারবে। উদ্দেশ্য র‌্যাম্পটি নির্মাণের সময় আরাকান রোডের নিচে বিভিন্ন ধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড লাইনেজ থাকায় আমাদের ১৩ মিটারের বক্স গার্ডার বসিয়ে পেশা করতে হয়েছে। নির্মাণের সময় আমরা এ র‌্যাম্প দিয়ে কোনো ভারী গাড়ি চলাচল করতে পারবে না বলে সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যানকে জানিয়েছিলাম। তার নির্দেশেই আমরা কাজটি শেষ করি এবং র‌্যাম্পটি ওঠার সময় ভারী গাড়ি চলাচল নিষেধ উল্লেখ করলেও পরে সে নির্দেশনা মানা হয়নি।
সিডিএর প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান প্রথমে ফাটলের ব্যাপারটি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘যে ফাটলের উক্তি বলা হচ্ছে সেটি আসলে কোনো ফাটল না। যা দেখা যাচ্ছে তা আসলে ফলস কাস্টিং। কলাম যখন একটা লিফট থেকে আরেকটা লিফটে ঢালাই হয় তখন সামান্য ফলস কাস্টিং বের হয়ে যায়। শাটারের ভেতর দিয়ে বা কোনো রকম গ্যাস-ট্যাস থেকে এ রকম সামান্য ফলস কাস্টিং বের হতে পারে। এটা ফলস কাস্টিংয়েরই একটা ক্র‌্যাক দেখা যাচ্ছে। এটা কলামের ক্র্যাক না।’
পরে অবশ্য তিনি তাঁর অভিমত পরিবর্তন করে বলেন, ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে ফাটল দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে এটি মেরামত সাধন হবে। আমরা নকশা প্রণয়নকারীদের সঙ্গে বসে পরবর্তী কাজের সিদ্ধান্ত নেব।
তবে র‌্যাম্পটি নির্মাণের সময় নকশা বা কাজের ত্রুটি ছিল না বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লাইওভারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১০ সালের ৫ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু করে সিডিএ। সংস্থাটির নিজস্ব অর্থায়নে ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফ্লাইওভারের মূল পেশা করেছে পারিশা এন্টারপ্রাইজ ও মীর আক্তার এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। উড়াল সড়কটি উদ্বোধন সাধন হয় ২০১৩ সালের অক্টোবরে। অন্যদিকে আরাকান সড়কমুখী র?্যাম্পটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ৩২৬ মিটার দীর্ঘ ও ৬ দশমিক ৭ মিটার চওড়া র‌্যাম্পটি নির্মাণ শেষে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয় সিডিএ।
ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ চলাকালে ২০১২ সালের ২৯ জুনের পর থেকে ১৩০ ফুট দীর্ঘ একটি কংক্রিটের গার্ডার ভেঙে পড়ে। এতে একজন রিকশাচালক আঘাতপ্রাপ্ত হলেও কেউ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। একই বছরের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের মধ্যবর্তী স্থানে তিনটি গার্ডার ধসে পড়ে। পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, দুর্ঘটনার পর গার্ডারের নিচ ও আশপাশ থেকে আটটি এবং বহদ্দার পুকুর থেকে চারটিসহ মোট ১২টি মরদেহ উদ্ধার সাধন হয়। এ ছাড়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় চমেকে মৃত্যু হয় আরো তিনজনের।