April 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, November 14th, 2021, 9:04 pm

শুধু জ্বালানি তেল নয়, বাড়ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশে দেশে বিধিনিষেধ জারি ও সীমান্ত বন্ধ থাকায় গত বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানির চাহিদা কমে যায় হু হু করে, সেই তালে কমে দামও। চলতি বছর সবকিছু আবার খুলতে শুরু করায় বিশ্বব্যাপী জ্বালানির চাহিদা আবার করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে এসেছে। তবে সরবরাহ সে তুলনায় বাড়ানো সম্ভব হয়নি।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সারা বছরের জন্য দেশের জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। অথচ গত ছয় মাসে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনতে গিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে সরকার। এরইমধ্যে ডিজেল, কেরোসিন ও এলপি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দামের বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে ক্ষতির মাত্রা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা কঠিন। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বাজারে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে। আর গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাড়বে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের উচ্চমূল্য থাকায় দেশের বাজারে তা সমন্বয় করতে এ পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বর্তমানে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে একটি খসড়া প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গিয়েছে। এ খসড়া চূড়ান্ত হওয়া সাপেক্ষে দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে চলতি মাসেই।
জানা যায় সংশ্লিষ্ট খাতের লোকসান কমাতে সরকার বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ বছরে সরকার ১০ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এ সময়ে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বেড়েছে ১১৮ শতাংশ। খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ। দেশে সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ওই সময় খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ ও পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
চলতি সময়ে বিদ্যুতের দাম কতোটুকু বৃদ্ধি করা হবে সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে জানানো হয়নি। সূত্র জানায়, বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করছে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাব্য হারের ওপর।
বিশ্বজুড়ে জ্বালানি পণ্য নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) বলছে, করোনা পরিস্থিতিতে সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক কর্মকা- থমকে যায়, আর কোথাও কোথাও সচল থাকলেও গতি ছিল কম। অর্থনৈতিক খাতগুলোতে সম্প্রতি করোনার প্রভাব কাটতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ফলে বিপুল পরিমাণ জ্বালানির চাহিদা তৈরি হয়েছে।
আইইএ বলছে, গত বছরের তুলনায় আগামী ডিসেম্বরের পরে তেলের চাহিদা আরও বাড়বে। আর বার্তা সংস্থা রয়াটার্স বলছে, করোনার টিকা নেওয়া আছে এমন বিদেশি নাগরিকের ওপর থেকে আগামী ৮ নভেম্বর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে যুক্তরাষ্ট্র। এতে জেট ফুয়েলের চাহিদা আরও বাড়বে। বার্তা সংস্থাটি আরও বলেছে, বর্তমানে তেলের দৈনিক বৈশ্বিক চাহিদার ৫ লাখ ব্যারেল ঘাটতি রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে গিয়ে এই ঘাটতি ৭ লাখ ব্যারেলে গিয়ে দাঁড়াবে। রয়াটার্সের এই বিশ্লেষণ ফলে গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে ডিসেম্বর নাগাদ তেলের দাম আরও বাড়বে।
জানা যায়, দেশে গ্যাসের চাহিদা পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলনের পাশাপাশি আমদানীকৃত এলএনজিও জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ক্রমেই বেড়েছে। যদিও জ্বালানি বিভাগ গ্যাস বিক্রি করছে আগের মূল্যেই। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে দিতে হচ্ছে সরকারকে। এ অবস্থায় দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি দিয়ে গ্যাসের সরবরাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কভিড মহামারীর আগে স্বাভাবিক অবস্থায় এক কার্গো এলএনজি আমদানিতে খরচ হতো ২৫০ থেকে ২৭০ কোটি টাকার মতো। বর্তমানে একই পরিমাণ এলএনজিবাহী কার্গো আমদানিতে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সে হিসেবে বর্তমানে দেশে এলএনজি আনতে হচ্ছে আগের চেয়ে অন্তত পাঁচ গুণ বেশি দামে। জ্বালানি পণ্য আমদানিতে গত এক বছরের ব্যয় বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে, এতে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দকৃত অর্থের চেয়ে অনেক বেশি।
গ্যাস ট্যারিফ আদেশের (২০১৯) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানিতে পেট্রোবাংলার খরচ ৯ টাকা ১৫ পয়সা ধরে সংস্থাটির জন্য এ বাবদ ভর্তুকি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সংস্থাটিকে নির্ধারিতের চেয়েও অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে এলএনজি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে, দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তার প্রভাব পড়বে বিদ্যুতেও। দেশে সরবরাহকৃত মোট গ্যাসের বড় একটি অংশ যাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে অন্তত ১ হাজার ৪০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের প্রয়োজন হয়। গ্যাস সংকটে বর্তমানে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাওয়ায় পিডিবি চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি হিসেবে ১৬ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। চীন এক বছর, ভারত ছয় মাসের জ্বালানি তেল মজুদ রাখতে পারে। আর বাংলাদেশ পারে মাত্র ৪২ দিনের। গত বছর তেলের দাম সবচেয়ে নিচে নেমে এলে তার সুবিধা নিতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিপিসি। তবে এ সময় বিকল্প মজুদের কথা আলোচনায় এলেও তার সুবিধা নেওয়া যায়নি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। এই বিকল্প মজুদ হতে পারত দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ট্যাংকার ভাড়া নিয়ে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বহু প্রতিষ্ঠান তেলের ট্যাংকার ভাড়া দিয়ে থাকে। এর বাইরেও সরকারি-বেসরকারি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ট্যাংকার ভাড়া নেওয়ার কথা তখন বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন। এটি করা গেলে অল্পদিনে ২৫ লাখ টন তেল সরকারি মজুদের বাইরে রাখা যেত। এতে দেশের চাহিদার ৮ মাসের সমপরিমাণ তেল মজুদ সম্ভব হতো।