জেলা প্রতিনিধি, সিলেট :
সিলেটের বিয়ানীবাজার -শেওলা স্থলবন্দর ৫০ কিলোমিটার সড়ক। এই সড়কের দুবাগ থেকে শেওলা স্থলবন্দর পর্যন্ত মাত্র তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বড় বড় গর্ত আর খানাখন্দের কারণে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন এই স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভারত-বাংলাদেশের ব্যবসায়ীসহ স্থানীয়রা।
আন্তর্জাতিক এই সড়কটি বর্ষায় জল-কাদায় একাকার আর শুষ্ক মৌসুমে ধুলা-বালির কারণে শেওলা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম কয়েকটি স্থলবন্দরের মধ্যে অন্যতম এই শেওলা স্থলবন্দর থেকে বড় অংকের রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা থাকলেও ধুলায় সেই সম্ভাবনা এখন ধূসর হতে চলেছে। একবার কেউ এই সড়ক দিয়ে চলাচল করলে ধুলার কারণে তাকে বাসায় ফিরে গোসল করতে হচ্ছে।
বছরে অর্ধশত কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হলেও এই সড়কটি টেকসইভাবে সংস্কার বা উন্নয়নে উদাসীন সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। অসংখ্য গর্তের কারণে আমদানি-রপ্তানিও কমে এসেছে। আশঙ্কাজনক হারে আমদানি-রপ্তানি কমে আসায় শেওলা স্থলবন্দরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মাত্র তিন কিলোমিটার সড়ক বেহাল সড়কের জন্য প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ ভুক্তভোগীরা বলছেন, সড়কটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের চালকরা শেওলা স্থলবন্দর যেতে চান না। তাই বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীদের এই স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিতে হয়।
এদিকে কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তা সড়কের বেহাল দশার কারণে রাজস্ব আদায় কমে এসেছে জানিয়ে বলছেন আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালানো হচ্ছে।
আমদানি-রপ্তানিকারকরা বলছেন, সরকার শেওলা স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি থেকে প্রতি বছর অর্ধশত কোটি টাকা রাজস্ব আয় করলেও শেওলা স্থলবন্দর সড়কের মাত্র তিন কিলোমিটার এলাকা সংস্কারে চরম উদাসীন সওজ। তাদের এমন উদাসীনতার কারণে সরকার প্রতিদিন বড় অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে। এই বন্দরের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও চরম বিপাকে আছেন।
গত ৯ নভেম্বর দুপুরে সিলেট-শেওলা স্থলবন্দর সড়কের শেওলা সেতু থেকে স্থলবন্দর পর্যন্ত মাত্র তিন কিলোমিটার সড়ক এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, একটি বড় গর্তের মধ্যে দশ চাকার ট্রাক আটকে আছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই ট্রাকচালক নুর উদ্দিন বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা পাথর নিয়ে সিলেট যেতে চাইছিলাম। কিন্তু পাথরবোঝাই করে আধা কিলোমিটার এলাকা পেরোনোর আগেই চাকা গর্তে আটকে গিয়ে ট্রাকটি বিকল হয়ে গেছে। এজন্য এই সড়ক দিয়ে পণ্য পরিবহন করতে মন চায় না। এখন বিপদে পড়েছি।
আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ী ও কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের কোষাধ্যক্ষ জয়দেব চক্রবর্তী বলেন, পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ব্যবসায়ীরা সরকারকে বছরে কোটি কোটি টাকা টাকা রাজস্ব ও ভ্যাট দিয়ে আসছেন। কিন্তু পণ্য রাখতে যেমন শেড নেই, তেমনি সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই কোনো গাড়ি এই সড়ক দিয়ে আসতে চায় না। মালামাল পরিবহন করতে না পারলে তো আর ব্যবসা করা সম্ভব হবে না। এতে আর্থিকভাবেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
সিলেট কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি চন্দন সাহা বলেন, বর্ষায় জল-কাদায় একাকার আর শুষ্ক মৌসুমে ধুলায় ধূসর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক। সড়কের এমন বেহাল দশার কারণে চলতি বছরের মাঝামাঝি বেশ কয়েকবার পণ্য ডেলিভারি বন্ধ ছিল। বাধ্য হয়ে বেশ কয়েকবার আমরা ব্যবসায়ীরা নিজ উদ্যোগে সড়কটি সংস্কার করেছি। এছাড়া সওজও একবার সড়কটি যেনতেনভাবে সংস্কার করে। ফলে সংস্কারের পরপরই সড়কটি আবার ভেঙে গেছে। এই সড়ক দিয়ে এখন চলাচল করলে ধুলার কারণে শ্বাসকষ্ট হয়। এই সড়কের বিষয়ে বলার কিছু নেই।
তিনি আরও জানান, শেওলা স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে চাল, চুনাপাথর, পাথর, ফলমূলসহ নিত্যপণ্য আমদানি হয়ে। এছাড়া ভারতে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য, নিত্যপণ্য, ক্রাউন সিমেন্ট, আকিজ গ্রুপের প্লাস্টিক ও গুঁড়ো দুধসহ বেশকিছু পণ্য রপ্তানি করা হয়।
তিনি বলেন, বেহাল সড়কের কারণে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে আমদানি-রপ্তানির সাথে সংশ্লিষ্টরা ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। কমছে আমদানি-রপ্তানিও।
বেহাল সড়কের কারণে আমদানি-রপ্তানি প্রভাবের কথা স্বীকার করে শেওলা স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. রোকন উদ্দিন বলেন, স্থল বন্দরটি সচল রাখতে আমরা কাজ করছি। এই মুহূর্তে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সাথে সড়কটির বিষয় নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আলোচনা করছেন।
এ বিষয়ে সওজের সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুবাগ ইউনিয়নের শেওলা সেতু থেকে শেওলা স্থলবন্দর পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার সড়কটি জেলা সড়কের মানের ছিল। ২০১৫ সালের ৩০ জুন শেওলা শুল্কস্টেশনকে স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হলে এই সড়কটি দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল শুরু হয়। একইসঙ্গে স্থলবন্দর দিয়ে পাথর-কয়লাসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী মালামালও আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। অতিরিক্ত লোডের কারণে সড়কটি ভেঙে যায়।
তিনি আরও জানান, শেওলা স্থলবন্দর সড়কটি দিয়ে পাথর-কয়লাসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী মালামাল আমদানি-রপ্তানি হওয়ার কারণে খারাপ হয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও সড়কটি সংস্কার করেছি। কিন্তু অতিরিক্ত লোডের কারণে সড়কটির নতুন নতুন এলাকা ভেঙে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। শুষ্কা মৌসুম হওয়ায় ধুলা বেশি উড়ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে এই নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, স্থলবন্দর ঘোষণার পর সিলেট নগরের কদমতলি-শ্রীরামপুর-গোলাপগঞ্জ-চারখাই-শেওলা স্থলবন্দর সড়ক নামের চার লেনের সড়ক নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন। এরই মধ্যে এই সড়কের জন্য একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এই সড়ক নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এ কারণে এই সড়কটির ওই তিন কিলোমিটার এলাকায় পুনরায় নির্মাণের জন্য বড় বাজেটের কোনো কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে না।
দুবাগ ইউনিয়নের স্থানীয় ইউপি সদস্য মোস্তফা আহমদ বলেন, এই সড়কের উভয় পাশে যাদের ঘরবাড়ি আছে তারা বড় বিপদে আছেন সড়কটির বেহাল দশার কারণে। সড়ক দিয়ে একবার চলাচল করলেই ধুলা-বালিতে শরীর ঢেকে যায়। তাই বাড়িতে ফিরে গোসল করতে হয়। আবার বর্ষা মৌসুমে সড়কে সৃষ্টি হওয়া গর্তে পানি জমে থাকায় কাদাপানিতে চলাচল করা দায় হয়ে পড়ে। আমরা এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাই।
সিলেট শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার আর বিয়ানীবাজার উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটা দূরত্বে দুবাগ ইউনিয়নে অবস্থিত শেওলা স্থলবন্দর। এটি আবার অনেকের কাছে সুতারকান্দি স্থলবন্দর নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শেওলা ও ওপারে সুতারকান্দি হওয়ায় স্থলবন্দরটি দুটি নামেই পরিচিত। তবে বাংলাদেশ সরকারের কাগজপত্রে এটি শেওলা স্থলবন্দর। সিলেট শহর থেকে বিয়ানীবাজার উপজেলায় যাওয়ার আগে শেওলা সেতু পার হয়ে দুবাগ পয়েন্ট। দুবাগ পয়েন্ট থেকে পূর্বদিকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরত্বে স্থল বন্দরটি অবস্থিত।
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার শেওলা শুল্কস্টেশনকে ২০১৫ সালের ৩০ জুন স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে এত দিন ঘোষণার মধ্যেই আটকে ছিল স্থলবন্দর প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ। শুল্কস্টেশনের অবকাঠামো, লোকবল নিয়েই চলছিল শেওলার কার্যক্রম। সেবাও প্রায় আগের মতোই। তবে গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি শেওলাকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরে রূপ দিতে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী শেওলা স্থলবন্দরের উন্নয়ন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন।
ওইদিন শেওলা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শেওলা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হচ্ছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট-১-এর আওতায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে উদ্বোধনের প্রায় দেড় বছর অতিবাহিত হলেও উন্নয়নকাজের ৩০ শতাংশই শেষ হয়নি।
প্রায় ২৫ একর জায়গার ওপর শেওলা স্থলবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় আগের ১৫ একরের বাইরে নতুন করে নয় একর জমি অধিগ্রহণসহ গোডাউন, ইয়ার্ড, নিরাপত্তা প্রাচীর, ওয়েব্রিজ স্কেল, ট্রাক পার্কিং, ডমেস্টিক ব্যারাক নির্মাণ করা হবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে এ শুল্কস্টেশনকে স্থলবন্দরে উন্নীত করা হয়।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি