নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে করোনা সংক্রমণ অশ্ব-গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংক্রমণের এই ধারণাতীত বৃদ্ধি দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে গোটা দেশকে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি সুপার ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনে সংক্রমণের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি টিকা প্রদানের গতি বৃদ্ধির পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা, সংক্রমণ গতির চেয়ে টিকা প্রদানের গতি খুবই শ্লথ। বলতে গেলে কচ্ছপ গতিতে এগোচ্ছে এই প্রক্রিয়া। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিন গুলিতে করোনা প্রতিরোধ যে বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
সূত্র জানায়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের ৮০ শতাংশই টিকা নেননি। ফলে করোনা নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞরা দেশব্যাপী নমুনা পরীক্ষা কার্যক্রম বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। অথচ টিকা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর মানুষের মধ্যে নমুনা পরীক্ষার আগ্রহ কমে গেছে। এটি বেশ উদ্বেগের একটি বিষয়। বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব, প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন লাখ নমুনা পরীক্ষা হওয়া উচিত।
করোনার এই ঊর্ধ্বগতি রোধে জনস্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোন বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আক্রান্তদের শনাক্ত করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁদের মতে, আক্রান্তদের থেকে অন্যান্যের থেকে পৃথক রাখা উচিত, যাতে অন্যান্যের মধ্যে ছড়াতে না পারে। সরকার এজন্য টিকা সনদ ছাড়া রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে না, মাস্ক ছাড়া গাড়িতে ওঠা যাবে না, গণপরিবহণের ড্রাইভার, হেলপার, যাত্রী সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু তদারকি না থাকায় তা কার্যকর হচ্ছে না।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারলে যে সংক্রমণ অনেকাংশে কমে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সংক্রমণ ঠেকাতে টিকা প্রদানের কোন বিকল্প নেই। টিকা হলো উচ্চমাত্রার প্রতিষেধক। এই টিকা প্রদান শতভাগ নিশ্চিত করতে না পারলে সংক্রমণে লাগাম দেওয়া যাবে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যে দেশে টিকা কার্যক্রমে গতি বাড়ছে না। বর্তমানে সরকারের কাছে প্রায় ৯ কোটি ডোজ টিকা মজুদ আছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী টিকাদান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার কথা বললেও সার্ভার জটিলতাসহ নানাবিধ কারণ ও আইসিটি খাতের দুর্বলতায় টিকা কার্যক্রম গতি পাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইতোমধ্যেই বিশ্বকে ওমিক্রনের ঝুঁকি বিষয়ে সতর্ক করে বলেছে, এতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমাদের মতো দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দেশে টিকাদান কর্মসূচি শক্তিশালী করার ওপর আরো মনোযোগ দেয়া উচিত। কারণ টিকা হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু কমাবে। তবে বিশেষজ্ঞরা করোনা সংক্রমণ রোধে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে যতটা সম্ভব জনসমাগম ও ভিড় এড়িয়ে চলা এবং সচেতনতায় গুরুত্বারোপ করেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি জনগণকে সম্পৃক্ত করার কথাও বলেছেন। বিশেষ করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও তরুণদের।
বাংলাদেশ সরকার শতভাগ টিকা নিশ্চিত করতে প্রয়াস যে চালাচ্ছে না তা কিন্তু নয়। চলমান টিকা কার্যক্রম গতিশীল করতে এটি সহজ করার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেছেন, টিকার কার্যক্রম চলছে এটা যে কোন উপায়ে চালু রাখতে হবে। এজন্য টিকা সংগ্রহের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। টিকা সংগ্রহের জন্য অর্থ যে কোন সোর্স থেকেই পাওয়া যায় সেগুলো সংগ্রহ করে টিকা আনতে হবে।
সূত্র জানায়, দেশের ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে আরও ১০ কোটি মানুষের জন্য ২০ কোটি ডোজ টিকা দরকার। গত কয়েকমাসে দেশজুড়ে টিকা দেওয়া হয়েছে মাত্র এক কোটি ডোজ। এই গতিতে টিকাদান কর্মসূচি চললে ২০ কোটি ডোজ টিকা দিতে সময় লাগবে সাড়ে ছয় বছর। দৈনিক যদি পাঁচ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া যায় তাহলে সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে সময় লাগবে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
করোনার এই নতুন ধাক্কা সহজে কাটার নয়। শতভাগ টিকা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দেশে করোনা ঝুঁকি থেকেই যাবে। টিকা নিশ্চিতের পাশাপাশি পরিস্কার, পরিচ্ছন্নতার প্রতিও জোর দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথম লকডাউনে যে ৩১ দফা দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম একটি দফা ছিল প্রতিটি শহরে আশেপাশের সকল স্থান পরিস্কার করতে হবে, গ্রামের সবখানে পরিষ্কার রাখতে হবে। সিটি করপোরেশন পরিচ্ছন্ন অভিযান শুরু করতে পারে। যেখানে পরিচ্ছন্ন থাকে সেখানে করোনা আক্রান্ত কম হয়, এটা একটি গবেষণায় ধরা পড়েছে। সুতরাং শহর এবং গ্রামে এ ধরনের ছোট্ট ছোট্ট পূর্তকর্ম হাতে নেওয়া যেতে পারে। খাল পরিষ্কার, ড্রেন পরিষ্কার কার্যক্রম হাতে নিতে পারে। গ্রামের রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজের মেরামত কাজ, চরের মধ্যে যে সব অবকাঠামো ভেঙ্গে গেছে-এ সব পূর্তকর্ম এখনি শুরু করে দেওয়া উচিত। এর ফলে করোনার এই মহামারীর মধ্যে খেটে খাওয়া যেসব মানুষ কর্ম হারিয়েছে তারা কাজ পাবে, আয় করতে পারবে, ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। কর্মহীনতা কমবে। মাননুষের হাতে টাকা আসবে। পাশাপাশি সরকার যে ৩৬ লাখ মানুষকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা করেছে সেটাও চলমান থাকবে।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় সারা দেশের শহরে ও গ্রামে ১ লাখ ২০ হাজার স্থায়ী টিকাকেন্দ্র আছে। হাম-রুবেলা বা অন্য কোনো টিকার বিশেষ প্রচারণার সময় এসব কেন্দ্র থেকে এক দিনে প্রায় ২ কোটি শিশুকে টিকা দেওয়া হয়। করোনার টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় কিছু শর্ত সাপেক্ষে টিকাকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। টিকা নেওয়ার পর হঠাৎ কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তা সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রেই থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত কোনো কোনো টিকা তীব্র শীতল তাপমাত্রায় সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থাকায় গ্রামাঞ্চলে টিকাকেন্দ্র স্থাপন থেকে বিরত থাকে সরকার। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বড় পরিসরে দেশব্যাপী কোনো সেরোসার্ভে চালানো হয়নি। আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআরবির পক্ষ থেকে যে দুটো সেরোসার্ভে চালানো হয়েছে তা শুধুমাত্র ঢাকা শহর এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের বস্তি এলাকার মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডির তথ্য দেয়। কোনোভাবেই তা গোটা দেশের সেরোপ্রিভ্যালেন্সের চিত্র তুলে ধরে না।
দেশ দীর্ঘদিন ধরে করোনার ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। এই দীর্ঘ সময়ে দেশের জনগণ জানতে পারলো দেশের শহর এবং গ্রামাঞ্চলে কোভিডের সেরোপ্রিভ্যালেন্স কোন অবস্থায় রয়েছে। তবে, সেরোসার্ভাইল্যান্সের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়েছিল মহামারির একদম শুরুতেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করোনাভাইরাসের একটি অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট নিয়ে সামনে এগিয়ে আসলেও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। দেশে উদ্ভাবিত এই কিট সময়মতো বাজারে আনতে পারলে আজ স্বল্প খরচেই দেশে সেরোসার্ভে চালিয়ে দেশের মানুষের ইমিউন স্ট্যাটাস বা সেরোপ্রিভ্যালেন্স জানা যেত।
সূত্র জানায়, গত বছর ১ নভেম্বর ঢাকায় ১২ বছরের বেশি বয়সি শিক্ষার্থীদের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ সামনের দিকে অনেক বাড়তে শুরু করবে এমন আশঙ্কা থেকে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ঘোষণা দেয়া হয়, দেশজুড়ে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি সব শিক্ষার্থীকে অন্তত এক ডোজ টিকা দেয়ার কাজ সম্পন্ন করা হবে। এক ডোজ টিকা নেয়া না থাকলে শিক্ষার্থীরা সশরীরে ক্লাসে যেতে পারবে না বলেও জানানো হয়। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের ঢাকার ১২টি কেন্দ্রে স্কুলের শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরে জানুয়ারিতে সেটি আরো সম্প্রসারণ করা হয়। গত ১০ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছিলেন, এখনো টিকা কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে প্রায় ৭৬ লাখ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ টিকার আওতায় আসেনি ৬৫ শতাংশের বেশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। তবে এ বিষয়ে দ্রুত টিকা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সি সব শিক্ষার্থীকে টিকা দেয়া শেষ হবে বলেও ওই দিন জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী।
করোনার এই নতুন তুমুল ঢেউ ঠেকাতে শতভাগ টিকা নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। টিকা প্রদানের গতিকে বাড়াতে সরকারকে এ ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অন্যথায় দেশকে সামনে আরও কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম