নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা যে হারে বেড়েছে, সে হারে ব্যবহার বাড়েনি। বরং বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। আর মহামারীকালে প্রতিদিনই সক্ষমতা ও উৎপাদনের এ অসামঞ্জস্যতা বজায় থাকছে। আর সক্ষমতার বড় একটি অংশ অব্যবহৃত থেকে যাওয়ায় আর্থিকভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশের বিদ্যুৎ খাত। যদিও এক দশক ধরে সরকার একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে যাচ্ছে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা গেলেও কাজে লাগানো যায়নি বিদ্যুৎ। ফলে বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা ও উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান থেকেই যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদার যে প্রাক্কলন করা হচ্ছে, তাতেও তারতম্য দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া হলেও ওই বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরি করা যায়নি। দেশে শিল্প-কারখানার বিকাশের পরিকল্পনা থেকে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও দেশে দৈনিক ৯-১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারের নজির খুব কম। দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। আর এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ উৎপাদনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট। অথচ সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার করা না গেলেও বিদ্যুৎ খাতে বিপুল ভর্তুকি দিয়েই চলেছে সরকার। সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। তার বিপরীতে আগের অর্থবছরের মার্চ থেকে গত অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিপিডিবির অনুকূলে শুধু ভর্তুকি বাবদমোট ৭ হাজার ৯৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ছাড় করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারির আংশিক ভর্তুকি বাবদ ১ হাজার কোটি টাকা সম্প্রতি অর্থ বিভাগ ছাড় করেছে। বাকিটা চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে সমন্বয় করা হবে। বিদ্যুতের লোকসান মেটাতে ২০১৪ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ৬ বছরে সরকার মোট ভর্তুকি দিয়েছে ৪২ হাজার ৮৫১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, দেশে সরকারি-বেসরকারি ও যৌথ ব্যবস্থাপনায় ২৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। তার মধ্যে সরকারি উদ্যোগে ৯টি, যৌথ উদ্যোগে ৩টি ও বেসরকারিভাবে ১২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। তাছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক আরো ৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে। ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১৩ হাজার ৬৫৯ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার ২০২০ সালে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট বছরের মধ্যে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বাইরে সরকারি-বেসরকারি এবং আমদানীকৃত বিদ্যুৎসহ গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা ২১ হাজার ৯৭৭ মেগাওয়াট। যার মধ্যে সরকারি উদ্যোগে আসবে ১৩ হাজার ৫৭১ মেগাওয়াট, বেসরকারি খাত থেকে প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট ও আমদানীকৃত বিদ্যুৎ থাকবে দেড় হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু দেশে মহাপরিকল্পনার ভিত্তিতে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বরং উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে নানা শর্তের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বেড়েছে ভর্তুকির পরিমাণ ও ঋণের বোঝা।
সূত্র আরো জানায়, দেশে ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা না থাকায় উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অনেকগুলো বসিয়ে রেখে সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় গত ১০ বছরে সরকার ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে। ভাড়ায় চালিত ওসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে তা ভর্তুকি দিয়ে গ্রাহকের কাছে বিতরণ করা হচ্ছে। আর প্রতি বছরই ভর্তুকির পরিমাণ দফায় দফায় বাড়ছে।
এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে যে পরিকল্পনা করেছিল তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। নানা উৎস থেকে অর্থায়ন পেয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করলেও ওই বিদ্যুৎ কোথায় ব্যবহার হবে, তার চাহিদা তৈরি করতে পারেনি। এর বড় একটি কারণ হলো সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে না পারা। তার বাইরে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা বলা হয়েছিল, সেটি যথাসময়ে না হওয়ায় ওসব জায়গায় বিদ্যুতের যে চাহিদা তৈরি হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। ফলে উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে এ জটিলতা দেখা দিয়েছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বিদ্যুতের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হুসাইন জানান, প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ানো যাচ্ছে না। তার প্রধানতম কারণ করোনা মহামারী। কভিডের কারণে শিল্প-কলকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিদ্যুতের ব্যবহার কম হচ্ছে। অন্যদিকে সঞ্চালন ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় সক্ষমতা থাকলেও বিদ্যুৎ বিতরণে প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। সব মিলিয়ে প্রাক্কলন করা হলেও সেটি নানামুখী সীমাবদ্ধতার কারণে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সদস্য (উৎপাদন) মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, বিপিডিবি প্রতিদিন যে চাহিদা প্রাক্কলন করছে, সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি নেই। তবে প্রাক্কলনে যে তারতম্য দেখা যায় তার কারণ হলো দেশের শিল্প-কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুতের চাহিদায় ওঠানামা। বিদ্যুতের ব্যবহার কম হওয়ায় দিনের প্রাক্কলনে তারতম্য হচ্ছে। যদিও রাতে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক থাকছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম