April 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, April 29th, 2022, 9:31 pm

সঞ্চালন দুর্বলতায় নিরবচ্ছিন্ন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বিদ্যুৎ সরবরাহ

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সঞ্চালন দুর্বলতায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অথচ বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণ। বিদ্যুৎ বিভাগ উৎপাদনে একের পর এক রেকর্ড গড়ছে। পাশাপাশি দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও সঞ্চালন দুর্বলতা প্রতিবন্ধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। সঞ্চালন লাইন শক্তিশালী করতে ইতিমধ্যে নেয়া অনেকগুলো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও সন্তোষজনক অগ্রগতি নেই। ধারণা করা হচ্ছিল ওসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সঞ্চালনের দুর্বলতা কেটে যাবে। কিন্তু আগামী ২০২৪ সালের আগে ওই প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হচ্ছে না। সঞ্চালনের এমন পরিস্থিতি বিদ্যুতের বড় প্রকল্পগুলোতেও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যুৎ সঞ্চালন অবকাঠামো যথাসময়ে প্রস্তুত করতে না পারায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শেষেও পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো যাচ্ছে না। পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০২০ সালের জুনে উৎপাদনে এলেও তা থেকে মাত্র ৫৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার গ্রিড লাইনের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অর্ধেক সক্ষমতায় চালানো হচ্ছে। বাকি অর্ধেক সক্ষমতা ব্যবহার না করে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। আর ২০২৩ সালে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। ইতিমধ্যে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের মূল কাজ শেষ হয়েছে। অথচ ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য যে লাইন প্রয়োজন তা এখনো শুরুর দিকে। ওই ইভাকুয়েশন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি মাত্র ২৪ শতাংশ। আগামী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। রূপপুরের বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য ৪০০ কেভি ৪৬৪ কিলোমিটার এবং ২৩০ কেভি ২০৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন রয়েছে। তার মধ্যে মোট ২০ কিলোমিটার নদী ক্রসিং। ইভাকুয়েশন প্রকল্পের নদী ক্রসিংয়ের জন্য সম্প্রতি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তাছাড়া জমি অধিগ্রহণ শেষ। এখন মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হচ্ছে।
সূত্র জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিে কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বিদ্যুতের সঞ্চালন অবকাঠামো বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত। সংস্থাটির মতে, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, দরপত্র আহ্বান ও কভিড মহামারীর কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে পড়েছে। এখন দ্রুতগতিতে বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। পিজিসিবির তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সংস্থাটির ২০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। যার সবই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্রিড কানেক্টিভিটি বাড়াতে নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে প্রকল্পের ধীরগতির কারণে মেয়াদ ও খরচ দুটোই বেড়ে যাচ্ছে। তাতে একদিকে যেমন ওসব প্রকল্পের আর্থিক সংকট তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে বিদ্যুতের মেগা প্রকল্পগুলোর উৎপাদন নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, রূপপুরের সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে ভারত। দেশটির ৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই প্রকল্পে কাজ করছে। গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রকল্পটি এলওসি (ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিট-৩) ঋণের আওতায় করা হচ্ছে। ওই প্রকল্পে মোট ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। যার সিংহভাগ অর্থায়ন করছে ভারত। তাছাড়া ভারত আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ দেশে আমদানির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে একটি সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তবে ওই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত এবং নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির লক্ষ্যে যে গ্রিড লাইন নির্মাণ হওয়ার কথা তার কাজ এখনো শুরুর দিকে। মূলত ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যবহারের লক্ষ্যে বড়পুকুরিয়া-বগুড়া কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ওই প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১২ শতাংশ। অথচ ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে আর মাত্র দুই মাস বাকি। ইতিমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রস্তাব পাঠিয়েছে পিজিসিবি। তাছাড়া দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নির্মাণ করা হচ্ছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে নির্মিত ওই প্রকল্পের জন্য ‘আমিনবাজার-মাওয়া-মোংলা ৪০০ কেভি’ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। চলতি বছরের জুন নাগাদ ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পদ্মা রিভার ক্রসিংয়ের কারণে এ বছর শেষ নাগাদ সময় লেগে যেতে পারে। ফলে রামপালের উৎপাদন শুরু হলে সেখানকার বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা না গেলে তা কোথায় ব্যবহার করা হবে তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
এদিকে সারা দেশে সঞ্চালন লাইনের সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে পিজিসিবির আরো এক ডজনের বেশি প্রকল্প চলমান রয়েছে। ওসব প্রকল্পের মেয়াদ চলতি ও আগামী ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হওয়ার কথা। অথচ পিজিসিবির বিদ্যমান অগ্রগতি দেখে বোঝা যাচ্ছে ওসব প্রকল্পের কাজ চূড়ান্তভাবে শেষ করতে আরো দুই-তিন বছর লেগে যাবে। তাছাড়া পিজিসিবির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্রিড সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ ৫৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের কাজ ৯ শতাংশ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মেইন পাওয়ার গ্রিড স্ট্রেংদেনিং প্রকল্পের কাজ ৫৯ শতাংশ, পাওয়ার সিস্টেম রিলায়েবিলিটি অ্যান্ড ইফিসিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের কাজ ৭ শতাংশ, গ্রিড বেজ পাওয়ার সাপ্লাইয়ের কাজ ২৯ শতাংশ শেষ হয়েছে। আর বাকি যেসব প্রকল্প রয়েছে সেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও তা নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে যাবে।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় সঞ্চালন ও অবকাঠামো খাত পিছিয়ে পড়ছে। এখন ওই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে শুধু উৎপাদন নয়, সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না পারলে তার জন্য সরকারকে কেন্দ্র বসিয়ে রেখে মাশুল গুনতে হবে। এখন সময় এসেছে সঞ্চালন ও বিতরণে সরকারের গুরুত্ব দেয়া। তাহলে বিদ্যুৎ খাতে একটা ভারসাম্য তৈরি হবে।
এ প্রসঙ্গে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম কিবরিয়া জানান, সঞ্চালন অবকাঠামো বিলম্বিত হওয়ার প্রধানতম জটিলতা হলো ভূমি অধিগ্রহণ। তা করতেই প্রকল্পের অর্ধেক সময় লেগে যায়। তারপর প্রকল্পের দরপত্র আহ্বানে জটিলতা রয়েছে। তাছাড়া এ খাতে যন্ত্রাংশ চীননির্ভর হওয়ায় কভিডের কারণে যথাসময়ে দেশে মালামাল শিপমেন্ট হয়নি। অনেকগুলো প্রকল্প থেকে বিদেশী কর্মী চলে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে বিলম্বিত হয়েছে কিছুটা। তবে এখন সব প্রকল্পে গতি পেয়েছে। আশা করা যায় দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব হবে।