নিজস্ব প্রতিবেদক :
নির্বাচন কমিশনে নুরুল হুদা যুগ সমাপ্ত হতে যাচ্ছে আগামী মাসের মাঝামাঝিতে। দেশের আপামর জনতা, সুশীল সমাজ ও রাজনীতিবিদরা এখন তাকিয়ে আছেন নতুনভাবে গঠিত হতে যাওয়া কমিশনের দিকে। এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, আলাপ-আলোচনাও কম হচ্ছে না দেশে। রাষ্ট্রপতিও ইসি গঠনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করেছেন, যদিও বিএনপি সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি। তবে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের যে বিকল্প নেই এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
গণতান্ত্রিক দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি একটি বলতে গেলে সব দেশেই স্বাধীন ও সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মূলত দেশে কোনো জাতীয় বা বড় পরিসরের নির্বাচনের সময় এলেই সংস্থাটির প্রতি সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় নির্বাচন কমিশন ও এর সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আমাদের দেশেও এমনই। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ১২ জন সিইসি বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বা এখনো করে চলেছেন। তাদের মধ্যে যার যার ভূমিকার কারণে দু-চারজনের নাম যেমন ইতিহাসে উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে, একই কারণে অজস্র নিন্দাও কুড়িয়েছেন বেশ কয়েকজন। দীর্ঘদিনের ব্যবধানে বিচারপতি এম ইদ্রিস, মোহাম্মদ আবু হেনা ও এ টি এম শামসুল হুদার মতো ব্যক্তিরা পৌনঃপুনিকভাবে সিইসির চেয়ারটির উপযুক্ত মর্যাদা বহুলাংশেই রক্ষা করে বস্তুত দেশে ও বিদেশে গোটা জাতির গৌরবময় ভাবমূর্তিটি তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে এই গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন আসনটিতে বসা কারো কারো বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য সমগ্র জাতির মর্যাদা একেবারে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে অনেকবার। এসব মনে হলে হতাশা ও লজ্জায় আমরা ম্রিয়মাণ হই। তবুও আমরা আশান্বিত হই, আশায় আশায় থাকি- বারবার নতুন করে আশায় বুক বাঁধি। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আমাদের মতো দেশে একটি অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বহুলাংশে নির্ভর করে ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছে ও মনোভাবের ওপর। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তথা নির্বাচন কমিশনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সাহস ও দৃঢ় মনোবলের বিষয়টিকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। সর্বশেষ ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কে এম নুরুল হুদা দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। একইদিন তার সহযোগী চারজন নির্বাচন কমিশনারেরও কার্যকাল শুরু হয়। সে অনুযায়ী বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কার্যকাল তিন বছর ছুঁই-ছুঁই। এ কাজে নতুন, এমন কথা বলার কোনো অবকাশ নেই- বর্তমান নির্বাচন কমিশন বেশ অভিজ্ঞ। ইতোমধ্যে নানা বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্তরের বেশকটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এই কমিশনের অধীনে। অবশ্য অনেকটা সময় গড়িয়ে গেলেও এসব বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, কোনো না কোনোভাবে এখনো চলছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে: প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যে রূপ নির্দেশ করিবেন, সেই রূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং ওই বিসয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারকে নিয়োগ করিবেন। সংবিধানে আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা থাকলেও গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই তা করেনি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইন করতে তাঁদের আপত্তি নেই। তবে এখন করার সময় নেই। ভবিষ্যতে আইন করা হবে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন বেশ শক্তিশালী এবং এর ওপর সরকার কোন হস্তক্ষেপ করতে পারে না বলে প্রচার করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ভারতের নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বেশি। ভারতে ক্ষমতাসীন সরকারই নির্বাচন কমিশন গঠন করে, যা নিয়ে তেমন বিতর্ক হয়নি। কিন্তু আমাদের এখানে নির্বাহী বিভাগ কিংবা সার্চ কমিটির মাধ্যমে যেই পদ্ধতিতেই কমিশন গঠিত হোক না কেন, বিতর্ক চলছেই। আইন না হওয়া পর্যন্ত সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের ধারণা মন্দ নয়। এতে অন্তত কমিশন গঠন সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব ও আকাক্সক্ষা জানা যায়।
জানা যায়, আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেবেন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। এর পরই সাংবিধানিক সংস্থাটিতে দায়িত্ব নেবেন নতুন ব্যক্তিরা, যাদের অধীনে হবে আগামী সংসদ নির্বাচন। তবে কারা আসছেন নতুন ইসিতে তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। নতুন নির্বাচন কমিশনারদের সম্ভাব্য তালিকার শীর্ষে রয়েছে সাবেক আমলা, বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের নাম। এদিকে বিগত সময়ের মতো এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আভাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য আগামী জানুয়ারিতে সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। সার্চ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে সংশ্লিষ্ট দফতরে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন সবার জন্য চ্যালেঞ্জ। এজন্য নিরপক্ষে নির্বাচন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন, যারা সঠিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নতুন নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের সম্ভাব্য তালিকায় সাবেক আমলা, বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে। নতুন সিইসি হিসেবে কাকে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে এ তালিকায়ও উঠে এসেছে বেশ কয়েকজনের নাম। একটি সূত্র জানিয়েছে, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সাবেক সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সাবেক জেলা জজ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের প্রাথমিক তালিকা তৈরি হয়েছে। তালিকা ধরে তাদের অতীত ইতিহাস যাচাই-বাছাই চলছে। এর মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে এক ডজন নাম নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। কমিশনার পদের জন্য ২০-২৫ জনের নাম আলোচনায় রয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনার পদে বিগত দুটি কমিশনের মতোই এবারও একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, একজন সাবেক জেলা জজ, সিভিল প্রশাসনের সাবেক একজন কর্মকর্তা ও একজন নারী সদস্য নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন।
এটি স্পষ্ট যে, নির্বাচন কমিশন গঠনের এখতিয়ার কেবল রাষ্ট্রপতির হাতে। সংবিধানে একটি ধারার অধীনে তিনি এ নিয়োগ দেবেন। তবে বিগত সময়ের মতো এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আভাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি মাসেই সার্চ কমিটি গঠন করা হবে বলে জানা গেছে। এরপর গঠন হবে নতুন নির্বাচন কমিশন। তবে সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশন ঠিক করে দেবে না, তারা রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করতে কিছু নাম বাছাই করে দেবে। রাষ্ট্রপতি তা থেকে নিয়োগ দেবেন।
তবে আইন তৈরি করে নির্বাচন কমিশন গঠন করলে ভালো হতো বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কেননা তাঁদের দাবি, অতীতে দুটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে ইসি গঠন হয়েছিল, তারা ভালো কিছু করতে পারেনি।
দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরিয়ে আনতে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। কাজেই সরকারকেও এ ক্ষেত্রে সদিচ্ছা পোষণের পাশাপাশি ফলপ্রসু পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায়, গণতান্ত্রিকভাবে আমরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হব, তেমনি বিশ্ব-দরবারে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম