নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকারি হাসপাতালের শৌচাগারের বেহাল দশা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এক সংসদ সদস্য। পরে তিনি সেখানকার ডিনকে ডেকে তাকে দিয়ে শৌচাগার পরিস্কার করান। এ ঘটনায় বেশ শোরগোল পড়ে যায়। যদিও ঘটনাটি প্রতিবেশি দেশ ভারতের, তবে বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্রও অভিন্ন। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর শৌচাগার বা টয়লেটের বেহাল দশা। রাজধানীর বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত টয়লেট, নেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। এর ফলে অনেকে জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালে গেলেও টয়লেট ব্যবহারে পড়েন বিড়ম্বনায়।
পুরুষের চেয়ে নারীরা এই সমস্যায় বেশি ভোগেন। অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা পরিবেশের টয়লেটের কারণে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন নারীরা। চিকিৎসকদের মতে, প্রতিবছর অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবহারে দেশের দুই কোটি শিশু টাইফয়েড, জন্ডিস, কলেরা বা ডায়রিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়াও অপর্যাপ্ত টয়লেটের কারণে প্রস্রাব চেপে রাখায় মূত্রনালিতে সংক্রমণ ঘটছে।
বিশেষ করে নারীরা ঘরের বাইরে গিয়ে পরিবেশ না পেয়ে জরুরি প্রয়োজনেও টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন না। আবার পিরিয়ডকালীন প্রয়োজনে টয়লেট ব্যবহার না করলে মূত্রনালির পাশাপাশি জরায়ুতে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। ফলে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন জরায়ুর সংক্রমণে। সূত্রমতে, রাজধানীর ১০টি সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতিদিন সবমিলিয়ে প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার রোগী ও তাদের স্বজনরা এসে থাকেন। যাদের বড় অংশ নারী। তবে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্য টয়লেট আছে ৪১টি।
এগুলোর মধ্যে আবার ১০টি তালাবদ্ধ ও ১৪টি ব্যবহার অনুপোযোগী। ফলে ব্যবহার উপযোগী আছে মাত্র ১৭টি টয়লেট। তবে টয়লেটের সঙ্গে হাত ধোয়ার বেসিন বা জায়গা আছে মাত্র দুইটি হাসপাতালে। অসংখ্য মানুষ ব্যবহার করার কারণে এসব টয়লেট প্রতি ঘণ্টায় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিষ্কার না করায় সেগুলো হয়ে পড়ে নোংরা ও ব্যবহারের অনুপযোগী। জানা যায়, দেশের চিকিৎসা সেবার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এখন ব্যবহারযোগ্য টয়লেট নেই বললেই চলে। ফলে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসা অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা পড়ছেন বিড়ম্বনায়। জরুরি প্রয়োজনে টয়লেট খুঁজলে ওয়ার্ডের টয়লেট দেখিয়ে দেন দায়িত্বরতরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আগে যে টয়লেট ছিল, তা এখন বন্ধ বলে জানান তারা। অন্যদিকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আছে মাত্র দুইটি টয়লেট। এর মধ্যে একটি তালাবদ্ধ, অন্যটি ব্যবহার করতে সিরিয়াল ধরে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘসময়। এদিকে শুধু সরকারি হাসপাতালেই নয়, রাজধানীতে পাবলিক টয়লেট সংকটের কারণে প্রতিদিনই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন মানুষ। যার ফলে রাস্তার পাশে, গাছের আড়াল, এমনকি ফুটপাতেই প্রস্রাব করছেন অনেকে।
ব্যবস্থাপনার অভাবে পুরো ঢাকা শহরটাই যেন এখন পাবলিক টয়লেট। বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকায় বাইরে চলাচল করা মানুষের প্রস্রাব-পায়খানার জন্য পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নেই। ঢাকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ ভাগ প্রতিদিন বাইরে যাতায়াত করে। এদের মধ্যে ৫০ ভাগ ভাসমান মানুষ। প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করছে। শহরের মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের জন্য রয়েছে একটি পাবলিক টয়লেট।
শহরের মোট ভাসমান মানুষ বিবেচনায় প্রায় ৭৫ হাজার জনের জন্য রয়েছে একটি টয়লেট। ঢাকায় মোট ১৩৩টি সচল পাবলিক টয়লেট রয়েছে। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬৩ এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭০টি। দুই সিটি করপোরেশরে তথ্য মতে, উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে ৫০টি সচল পাবলিক টয়লেট আছে। এর মধ্যে ২৩টি পুনরায় সংস্কার করা হয়েছে। আরও নতুন ৫০টি স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। যা ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা। উত্তরের সবগুলোতে নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও দক্ষিণের অধিকাংশগুলোতে নেই।
এদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে সর্বমোট পাবলিক টয়লেট আছে ৯০টি। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। সচল ৫০টির মতো। এগুলো আবার সিটি করপোরেশন বেসরকারি পর্যায়ে ইজারা দিয়ে পরিচালনা করছে। সরকারি নজরদারি না থাকায় ইজারাদাররা বেশি টাকা আয়ের জন্য পাবলিক টয়লেটের পানি বিভিন্ন পানি ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করছে। অনেকেই আবার টয়লেটগুলোকে মাদক ব্যবসায়ীদের লেনদেনের নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেন, আমরা চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে টয়লেট নির্মাণ করছি। তবে কিছু স্থানে জমি সংকট থাকার কারণে প্রয়োজন থাকলেও নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে বর্তমানে ৫০টি সচল পাবলিক টয়লেট আছে। এর মধ্যে ২৩টি পুনরায় সংস্কার করা হয়েছে। আরও নতুন ৫০টি স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে, যা ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা। এগুলো চালু হলে টয়লেটের সংখ্যা বাড়বে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. মোহাম্মদ সফিউল্লাহ সিদ্দিক ভুঁইয়া বলেন, আমাদের সিটিতে নতুন করে যেখানেই সেকেন্ডারি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র (এসটিএস) নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানেই চেষ্টা করা হচ্ছে একটি করে পাবলিক টয়লেট তৈরির। আর দক্ষিণের নতুন সবগুলো পাবলিক টয়লেটে পুরুষ, নারী, প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থাসহ শিশুদের ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণারও থাকবে-এমন ১৫টি পাবলিক টয়লেট এ বছর নির্মাণ করা হবে।
এদিকে টয়লেটের অপ্রতুলতা ও অপরিচ্ছন্নতায় জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের হাসপাতালের টয়লেটগুলো নারীদের জন্য উপযোগী নয়। এতে দেখা যায়, টয়লেটের সুবিধা না থাকায় তারা পানি পান করেন না বা কমিয়ে দেন। কিংবা অনেক সময় ধরে প্রস্রাব আটকে রাখেন। এতে কিডনির সমস্যা হচ্ছে। মূত্রথলির পাশাপাশি জরায়ুর ইনফেশন হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, একটি আধুনিক শহর গড়ার অন্যতম অনুষঙ্গ পাবলিক টয়লেট। গত চার-পাচ বছরে দুই সিটি করপোরেশন প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করেছে। সেগুলোও জনসংখ্যার তুলনায় খুব কম। এর সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। ফুটপাতে পস্রাব করে পরিবেশ নষ্ট করার বিষয়ে তিনি বলেন, আমদের দেশে যেখানে সেখানে প্রস্রাবকরা যাবে না, এই নিয়ম যে আছে মানুষ তা মানছে না। এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রথম অবস্থায় শাস্তির ব্যবস্থা না করে মানুষকে কাউন্সিলিংয়ের মাধমে বোঝাতে হবে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি