নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বেশিরভাগ রোগীই শয্যা না পেয়ে মেঝে-বান্দায় থাকছে। মূলত সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় কাউকে ফিরিয়ে দেয়া হয় না। কিন্তু অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবেই অধিকাংশ রোগী শয্যা পায় না। দেশের বিশেষায়িত সব সরকারি হাসপাতালে শয্যার চেয়ে ৫৩ শতাংশ রোগী বেশি ভর্তি হয়।স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যানুযায়ী দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৪টি শয্যা রয়েছে। তার মধ্যে সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৪৯ হাজারের কিছু বেশি। যার ৩২ শতাংশ বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোয় রয়েছে। তবে স্বাস্থ্যসেবার শীর্ষ পর্যায়ের ওসব হাসপাতালে রোগী ভর্তির হারও সবচেয়ে বেশি। ১৫৩ শতাংশ রোগী চিকিৎসার জন্য ওসব হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের হাসপাতালে শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তির হার ১৩৭ শতাংশ। তবে প্রাথমিক পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যার তুলনায় কম রোগী ভর্তি হচ্ছে। উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা তার নিচের পর্যায়ের হাসপাতালে শয্যার বিপরীতে ৭৮ শতাংশ রোগী ভর্তি হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এলে কাউকে ফিরিয়ে দেয়া হয় না। ফলে রোগী ভর্তি বেশি হয়। সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪২৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ ১০ শয্যা, ২০ শয্যা, ৩১ শয্যা ও ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বিভিন্ন শয্যার হাসপাতালের সংখ্যা ৪৮৫টি। মাধ্যমিক পর্যায়ে রয়েছে ১০০ থেকে ২৫০ শয্যার ৬২টি জেলা ও জেনারেল হাসপাতাল। টারশিয়ারি বা বিশেষায়িত পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যাা ৩০টি। বিশেষায়িত প্রতিটি হাসপাতালে ৫০০ থেকে ২ হাজার পর্যন্ত শয্যা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে টারশিয়ারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শয্যার চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) মোট শয্যা সংখ্যা এক হাজার। তবে তার প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি রোগী সেখানে ভর্তি রয়েছে। আর বাড়তি রোগীদের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় চিকিৎসার জন্য তাদের ঠাঁই হয় মেঝে ও বারান্দায়।
সূত্র জানায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সেবা না পাওয়া মানুষ বিশেষায়িত হাসপাতালে ভিড় করছে। আর স্বাস্থ্যসেবার জন্য এখনো বাজেট অনেক কম। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ গ্রামে বাস করলেও তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এখনো জেলা পর্যায়ে সব রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়নি। রোগ নির্ণয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলো। জেলা হাসপাতালেও যখন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকে না তখন মানুষের বিশেষায়িত হাসপাতালে ভিড় করাই স্বাভাবিক। কারণ সাধারণ মানুষ জানে না কোথায় গেলে কোন সেবা পাওয়া যাবে। জানলে তারা বিশেষায়িত হাসপাতালে ভিড় করতো না। অথচ ওসব হাসপাতালে আসা রোগীর চিকিৎসা জেলা বা উপজেলা হাসপাতালে সম্ভব ছিল। হয়রানি, অব্যবস্থাপনা, রোগ নিরীক্ষণ ও অন্যান্য সেবার অভাবে মানুষ বড় হাসপাতালগুলোতে ভিড় বাড়ছে। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৮৫০ শয্যায় বিশেষায়িত চিকিৎসা দিচ্ছে। তবে ওই প্রতিষ্ঠানটিতে সাধারণত ১ হাজার ২০০ রোগী ভর্তি থাকে। ওয়ার্ডের মেঝে ও বারান্দায় শয্যার বাইরের রোগীদের ভর্তি করা হয়। একটি শয্যার জন্য বহু রোগীকে অপেক্ষায় থাকতে হয়। কেউ চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র পেলে বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে তখনই শয্যা খালি হয়। ওষুধ, লোকবলসহ অন্যান্য উপকরণ নির্ধারিত শয্যার বেশি সরকার থেকে বরাদ্দ নেই। তবে অপ্রতুল হলেও ওই বরাদ্দেই বাকিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে এদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা ১ দশমিক ৫ জন। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রয়েছেন দশমিক ৬ জন। প্রতি চিকিৎসকের বিপরীতে ৩ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র দশমিক ৩০ জন। দেশে রোগীর অনুপাতে হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসক, বরাদ্দ, লোকবল কিছুই পর্যাপ্ত নেই। ফলে ১০০ রোগীর জন্য বরাদ্দ পাওয়া অবকাঠামো ও লোকবল দিয়ে ২০০ রোগীকে সেবা দেয়া হয়। সরকার যে পরিকল্পনা নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন পর্যায়ে ভাগ করেছিল তাতে ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকে রোগী ব্যবস্থাপনা করলে বিশেষায়িত হাসপাতালে অতিরিক্ত চাপ পড়তো না। কারণ সাধারণ মানুষই জানে না যে কোন রোগের জন্য কোথায় যেতে হবে। ফলে বিশেষায়তি হাসপাতালগুলোর ওপরই চাপ বাড়ছে। তবে সরকার-সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের সব সরকারি হাসপাতালের বাইরে বড় বোর্ডে উল্লেখ থাকে কোন চিকিৎসা পাওয়া যাবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে শয্যা বাড়ানো হয়েছে। অন্য হাসপাতাল থেকে জরুরি প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগের চেয়ে জেলা হাসপাতালে রোগ নিরীক্ষণের ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়েও আগের চেয়ে স্বাস্থ্যসেবার মান ভালো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এএনএম শামসুল ইসলাম জানান, জরুরি না হলে কেউ হাসপাতালে আসে না। তবে কোন হাসপাতালে কোন চিকিৎসা রয়েছে সে বিষয়ে জানার ঘাটতি রয়েছে। রোগ প্রতিরোধ, সচেতনতা, সংকটসহ যাবতীয় সমস্যা সমাধান করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রাখা জরুরি। সব সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে একসময় অতিরিক্ত রোগী ভর্তির প্রয়োজন পড়বে না। একই সঙ্গে হাসপাতাল ও শয্যা সংখ্যাও বাড়াতে হবে। কিন্তু রোগী ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হলে এ সমস্যা রয়েই যাবে।
অন্যদিকে প্রতিরোধী ব্যবস্থার ক্ষেত্রে হেলথ প্রমোশনের বিষয়টিকে সরকার গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র এবং লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পত্রিকা, টেলিভিশন ও ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ওই বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। ওই কার্যক্রম আরো বাড়ানো হচ্ছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম