নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকার বলছে দেশে সারের কোনো সঙ্কট নেই। কিন্তু কৃষকরা বলছে, সার কিনতে গেলে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা সঙ্কটের কথা বলছে। তবে দাম বেশি দিলেই সার বের করে দিচ্ছে। কিছু কিছু ডিলার দোকানে মূল্যতালিকা টাঙিয়ে রাখলেও ওই অনুযায়ী বিক্রি করছে না। এমনকি সরকারি দরের রসিদ দিলেও বাড়তি দরের রসিদ দিচ্ছে না। প্রতিবাদ করলে সার বিক্রি করবে না জানিয়ে দিচ্ছে বা ক্রেতার কাছে বিক্রি করা সার কেড়ে নিয়ে রেখে দিচ্ছে। ডিলারদের কাছে এভাবে জিম্মি হয়ে কৃষকরা অসহায়বোধ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বিপুল ভর্তুকি দিলেও অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে কৃষককে বাড়তি দামে সার কিনতে হচ্ছে। চলতি বোরো মৌসুমের শুরুতেই সারের সঙ্কট চরমে পৌঁছেছে। যে কারণে কেজিতে সারের দাম ২ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। শতকরা হিসাবে যা ১২ শতাংশ। আগে প্রতি কেজি ইউরিয়া সার খুচরা বাজারে ১৭ টাকায় বিক্রি হতো। এখন তা ১৯ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া পাইকারি বাজারে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। টিএসপি, পটাশ ও এমওপি সারের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পাশাপাশি রয়েছে ব্যবস্থাপনা সংকটও। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর সারের পরিবহণ বৃদ্ধিতে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে পরিবহণ ঠিকাদাররা পণ্য পরিবহণ করেনি। ওই কারণে খুচরা পর্যায়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সরকার বিগত ১২ বছরে সারে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ভতুর্কি দিয়েছে। কিন্তু েেক্ষত্রে দুর্নীতির কারণে ভর্তুকির পুরো সুফল পাচ্ছে না কৃষক। ভুক্তভোগী কৃষক, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দু’মাস আগেও যেখানে এক বস্তা ইউরিয়া সার ৮০০ টাকায় পাওয়া যেতো এখন তার দাম ৯০০ টাকা। পটাশ সার তো পাওয়ায় যাচ্ছে না। আর পাওয়া গেলেও ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১৬০ টাকার দস্তা সার ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমনকি টিএসপি সার পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও ২ হাজার থেকে ২২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ৫ ধরনের সার বেশি ব্যবহার হয়। তার মধ্যে ইউরিয়ার মজুত ১ লাখ ৪০ হাজার টন আর প্রতি কেজি সরকারি দাম ১৬ টাকা। আর বাজারে ১৭ টাকা বিক্রির কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ১৯ টাকারও বেশি দামে। ডিএপি সারের মজুত ৭১ হাজার টন। আর সরকারি দাম প্রতি কেজি ১৬ টাকা। বাজারে বিক্রির কথা ১৮ টাকা। তবে বিক্রি হচ্ছে ২২ টাকায়। তাছাড়াও পটাশ মজুত ৪৫ হাজার টন এবং টিএসটি ৩০ হাজার টন। কিন্তু সব সারেই কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা দাম বেড়েছে।
সূত্র জানায়, গত বছরে দেশে মোট ৫৯ লাখ ৩৪ হাজার টন রাসায়নিক সারের চাহিদা নিরূপণ করা হয়। তার মধ্যে ইউরিয়া ২৬ দশমিক ৫০ লাখ টন। সেক্ষেত্রে দেশে উৎপাদন ৫০ শতাংশ। বাকিটুকু আমদানি করতে হয়। টিএসপির চাহিদা ৭ দশমিক ৫০ লাখ, ডিএপি ৯ লাখ, এমওপি ৮ দশমিক ৫০ লাখ ও এমএপি শূন্য দশমিক ৫০ লাখ টন। অন্যান্য রাসায়নিক সারের মধ্যে জিপসাম ৪ লাখ টন, জিংক সালফেট ১ লাখ ৩৩ হাজার, অ্যামোনিয়াম সালফেট ১০ হাজার, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ৮০ হাজার ও বোরন ৪১ হাজার টন। আর এনপিকেএস ৭০ হাজার টন নির্ধারণ করা হয়েছে। ওসব সারের বাজারমূল্য থেকে বেশি দামে সারের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকার ভর্তুকি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সেক্ষেত্রে শুধু ইউরিয়া সারেই প্রতিবছর সরকারের ভর্তুকি ১২ হাজার কোটি টাকা। বিগত ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৬৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকার ভর্তুকি সহায়তা দিয়েছে সরকার। তার মধ্যে সার বাবদ ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৫৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। তাছাড়া সারে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ১২ বছরে শুধু সারেই প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বছরে তা ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
সূত্র আরো জানায়, সরকার প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) টিএসপি সারের খুচরামূল্য ১ হাজার ১০০ (২২ টাকা প্রতি কেজি), এমওপি প্রতি বস্তা ৭৫০ (১৫ টাকা প্রতি কেজি), ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও ইউরিয়া প্রতি বস্তা ৮০০ টাকা (১৬ টাকা প্রতি কেজি) নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু অসাধু চক্রের কৃত্রিম সঙ্কটে বাজারে ওই দামে সরকার বিক্রি হচ্ছে না। অথচ ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জমিতে সেচ দেয়া শুরু হয়েছে। ওই সেচ দেয়ার যন্ত্রের প্রধান জ্বালানি ডিজেলের দাম বাড়ানোয় এবারের বোরো মৌসুমে কৃষকের সেচ বাবদ বাড়তি খরচ হবে ৭৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে কৃষকের বিঘাপ্রতি সেচের জন্য বাড়তি ৩০০ টাকা খরচ জোগানোর পাশাপাশি ধান বিক্রিতে প্রায় ৩ শতাংশ মুনাফা কমবে। এমন পরিস্থিতিতে যদি সারও বাড়তি দামে কিনতে হয় তবে কৃষক আগামী বছর কৃষকরা ধান আবাদে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। যা চালের সঙ্কট আরো বাড়াবে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান জানান, সারের দাম কোথাও বেশি না। দু-এক জায়গায় হয়তো খুচরা বিক্রেতারা বেশি দামে বিক্রি করছে। কিন্তু বাস্তবে সারা দেশে পর্যাপ্ত সার মজুত আছে। ডিলারদের ক্ষেত্রে ১২ বছর আগে যে কমিশন ছিল এখনো ওই হারে কমিশন আছে। কিন্তু তার মধ্যে ডিজেলের দাম, পরিবহণ খরচ এবং শ্রমিকের মূল্য বেড়েছে। তারপরও ডিলাররা একই কমিশনে সার বিক্রি করে আসছে। দেশে সরকারি-বেসরকারি খাতে পর্যাপ্ত সার আমদানি করা হয়েছে। ফলে সারের কোনো ঘাটতির আশঙ্কা নেই।
অন্যদিকে অতিসম্প্রতি সার নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। ওই শেষে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানান, দেশে সারের পর্যাপ্ত মজুত আছে। তারপরও একশ্রেণির অসাধু ডিলার সিন্ডিকেটের কারণে কৃষককে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৫ দিন উপজেলা পর্যায়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। প্রয়োজনে এই সময় বাড়ানো হবে। আর শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন জানান, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি বোরো চাষ মৌসুম। আর ওই মৌসুমে সারের দাম নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।এ প্রসঙ্গে কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক জানান, মজুত এবং পাইপলাইন মিলিয়ে জুন পর্যন্ত সারের কোনো সমস্যা হবে না। তবে দামে সমস্যা হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। অবশ্যই বাজারে সারের দাম বেশি ছিল। এ সময়ে বস্তায় ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। তার কারণ নভেম্বরে সারের প্রয়োজন বেশি হয়। এই সময়ে আলু এবং অন্যান্য সবজির জন্য টিএসপি ও এমওপি সার বেশি লাগে। কিন্তু নভেম্বরে যখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় তখন বারবার কৃষিপণ্য পরিবহণ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা নিশ্চিত করা হয়নি। ঠিকাদাররা পর্যাপ্ত সারের ডেলিভারি করেনি। অথচ পর্যাপ্ত মজুত ছিল। কিন্তু খুচরা বিক্রেতাদের জন্য যে গুদাম ছিল সেখানে পর্যাপ্ত মজুত ছিল না। সেক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ছিল। তবে এ মুহূর্তে সারের কোনো সংকট নেই। কারণ নন ইউরিয়ার চাহিদা কমে গেছে। আর কিছুদিন পর ইউরিয়ার চাহিদা বাড়বে। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মজুত আছে। আর মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ডিলারদের ডিস্টার্ব না করে পরিবহণ ঠিকাদারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিবহণ নিশ্চিত করলেই বাজার স্থিতিশীল হবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি