November 19, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, December 7th, 2021, 8:55 pm

সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দেশের সব থানায় আলাদা বিট গঠনের উদ্যোগ

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সাইবার অপরাধীরা দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অপরাধের সংখ্যাও। সাইবার অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানায় চালু হচ্ছে পৃথক সাইবার বিভাগ। সম্প্রতি ঢাকা রেঞ্জের প্রতিটি জেলায় এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, শিগগিরই দেশের সব থানায় সাইবার অপরাধের জন্য আলাদা বিট গঠন করা হবে। পুলিশ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সিআইডি পুলিশের সাইবার ইউনিটের প্রতি মাসে কমপক্ষে ৩ হাজার সাইবার অপরাধের অভিযোগ মিলছে। মামলা হলে জড়িতরা আটকও হচ্ছে। তবে চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ওই ধরনের অভিযোগ আরো বেড়েছে। নারীদের পাশাপাশি অনেক পুরুষও সেক্সটরশনের (যৌন সম্পর্কের ঘটনা ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে সুবিধা আদায়) শিকার হচ্ছে। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে সামাজিক বা ব্যক্তি-মর্যাদাহানি, ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায় বা অন্য কোনো সুবিধা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, পর্নোগ্রাফি আইন, আইসিটি আইন, টেলিকমিউনিকেশন আইনে সারা দেশে বিগত ২০১৫ সালে যেখানে ৬৩৮টি মামলা হয়েছে, সেখানে ২০২০ সালে এসে ওই সংখ্যা ১ হাজার ৪৫৯টিতে দাঁড়িয়েছে। গত বছর ডিএমপির সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের এক পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, ১৮ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৭ শতাংশ, ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ, ২৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ এবং ৫৫ থেকে বেশি বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে ৩ শতাংশ তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অপরাধে জড়াচ্ছে।
সূত্র জানায়, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি) সাইবার অপরাধ নিয়ে প্রতিদিনই অভিযোগ জমা পড়ছে। অনেক নারী ও তরুণী সাইবার ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। গত বছর পুলিশ সদর দফতরে এলআইসি শাখার অধীনে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সেল চালু করা হয়েছে। নারীরাই বেশি মাত্রায় সাইবার হামলার শিকার হওয়ার কারণে পুলিশ সদর দফতর ওই উদ্যোগ নেয়। হটলাইন নম্বর, ফেসবুক পেজ, ইমেইল, মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা ভার্চুয়ালি ওই সেলকে অবহিত করতে পারেন। আর ওই সেলে দায়িত্বরত সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে ভুক্তভোগীকে সহায়তার উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর যাত্রা শুরু করার পর ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ওই সেল ১৭ হাজার ৭৭০টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে। ওসব অভিযোগের ৪৩ শতাংশ ছিল ফেক আইডি-সংক্রান্ত। ১০ শতাংশ আইডি হ্যাক, ১৫ শতাংশ ব্ল্যাকমেইলিং, ১২ শতাংশ মোবাইল হ্যারাসমেন্ট, ৮ শতাংশ আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানো এবং বাকি ১২ শতাংশ ছিল অন্যান্য অভিযোগ।
সূত্র আরো জানায়, গুজব ছড়ানোর দায়ে এখন পর্যন্ত ১১২টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট শনাক্ত হয়েছে। অ্যাকাউন্টগুলো অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, লিবিয়া ও সৌদি আবর থেকে পরিচালিত হচ্ছে। ওসব অ্যাকাউন্ট পরিচালনার সঙ্গে ৬০ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। তাদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত নানা সমস্যার বিষয়ে গত বছর অভিযোগ এবং ফোনকলের সংখ্যা ছিল ২৭ হাজার ৭৮৬টি। আর চলতি বছর ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ওই সংখ্যা ২১ হাজার ৯৪২টি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের দেশে পৃথকভাবে সাইবার থানা স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। ওই ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। তবে সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের দুর্ভোগ লাঘবে সর্বসম্মতিক্রমেই পৃথক সাইবার থানা স্থাপন না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ পৃথক সাইবার স্থাপন করলে ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ বাড়াবে। ভুক্তভোগীদের ওসব থানায় গিয়ে মামলা করতে হবে। আর পুরো রাজধানীতে এমন থানা করা সম্ভব নয়। সেজন্য প্রতিটি থানায় পৃথক সাইবার বিভাগ চালু করা হচ্ছে। থানা কম্পাউন্ডে থাকা ওই সাইবার বিভাগে সাইবার-সংক্রান্ত মামলাগুলো দায়ের হবে। মামলাগুলোর তদন্ত করতে প্রাথমিকভাবে দুজন করে পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে, যারা প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ও পারদর্শী হবে।
এদিকে সাইবার আক্রমণের শিকার হয়ে অনেক ভুক্তভোগী কেবলই চোখের জল ফেলছে। প্রশ্নের মুখে পড়ছে অনেকের সামাজিক মর্যাদা। তবে ব্যক্তি পর্যায়ের সাইবার অপরাধ নিয়ে বেশি আলোচনা হলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর সাইবার হামলার বিষয়গুলো অনেকটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগের পরামর্শ দেয়া হলেও তা শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইবার অপরাধ নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। সাইবার অপরাধ সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বাড়ানোর ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অপরাধ মোকাবিলার সঙ্গে জড়িতদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য দেশব্যাপী ইতিবাচক প্রচারণা।
অন্যদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরের এক অনুষ্ঠানে সাইবার অপরাধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গ্রাম পর্যায়েও প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগার কারণে সাইবারকেন্দ্রিক অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেজন্য সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে ভাবা হচ্ছে। দেশের সব থানায় সাইবার-সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে মামলা হচ্ছে। ওসব মামলার তদন্ত দ্রুত করতে প্রতিটি থানায় পর্যায়ক্রমে সাইবার বিভাগ চালু করা হবে। শুধু ব্যক্তি বা সমাজ নয়, অনেক সময় রাষ্ট্রও এর শিকার হচ্ছে। গত প্রায় এক বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ১৭ হাজারের বেশি নারী হয়রানির শিকার হয়েছে। তার আগে গত সেপ্টেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এক সংবাদ সম্মেলনে বিটিআরসির সক্ষমতা তুলে ধরে বলেন, বিটিআরসি শুধু ইউটিউব, ফেসবুকের কোনো কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ করতে পারে। ওই কনটেন্ট তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড পরিপন্থী হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তা অপসারণ করে, নয় তো করে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকারের পক্ষে ইন্টারনেট জগতে কোনো কিছু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ সালে প্রণয়ন করা হলেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে ২০২১ সালে এসেও আইনটি অপরাধ দমনে বিস্তৃত ভূমিকা রাখছে না। আইনের অপপ্রয়োগ মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা সম্ভব। আর সাইবার অপরাধ প্রসঙ্গে ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক হাবিবুর রহমান বলেন, সাইবার অপরাধের ধরন ও গতিপ্রকৃতি অন্য সব অপরাধ থেকে ভিন্ন। তাতে বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে ভিকটিমকে সেভ করার জন্য প্রতিটি থানায় পৃথক বিট গঠন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ঢাকা রেঞ্জের ১৩টি জেলার কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে থানাওয়ারি অফিসারদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাইবার ডেস্কের জন্য উপযোগী করে তোলা হবে।
এ প্রসঙ্গে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপকমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া জানান, প্রতিদিন আমাদের কাছে কমপক্ষে ৩০-৪০টি মৌখিক ও লিখিত সাইবার সম্পর্কিত অভিযোগ আসছে। তার মধ্যে ব্ল্যাকমেইলিং, মোবাইল ব্যাংকিং ও পর্নোগ্রাফির অভিযোগই বেশি। আর অভিযোগের ধরন বুঝে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।