May 19, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, October 10th, 2023, 8:16 pm

সাতক্ষীরার ইউসুফ প্রবাসী শ্রমিক থেকে কাতার জাতীয় দলে

অনলাইন ডেস্ক :

গেল চার বছর গালফার আর মিসনাদের হয়ে খেলেছেন ইউসুফ। ব্যাটে-বলে দারুণ ছন্দে ছিলেন ২০২২ সালে। শেষ চার ওয়ানডেতে ছয় উইকেট পেয়েছিলেন। ইকোনমি ছিল ২.২০। মূলত এমন কিপটে বোলিংয়ে নজর কাড়েন কাতার জাতীয় দলের নির্বাচকদের। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তাঁর অভিষেক হয়েছিল কানাডার বিপক্ষে; আইসিসি কোয়াইলিফায়ার-এ। সেই টুর্নামেন্ট হয়েছিল মালয়েশিয়ায়। দ্বিতীয় ম্যাচে ভানুয়াতুর বিপক্ষে ১০ ওভার বোলিং করে নিয়েছিলেন এক উইকেট। কিন্তু ফিল্ডিং করতে গিয়ে হাতে মারাত্মক ব্যথা পান। ইনজুরির ছোবলে ছিটকে পড়েন। দীর্ঘ আট মাস মাঠের বাইরে ছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর লীগে খেলেন টাইটানসের হয়ে। সাত ওয়ানডেতে ১০ উইকেট নেন। আর তিন টিটোয়েন্টিতে তিন উইকেট নেন। ফলে আবার জাতীয় দলে ডাক পড়ে।

কাতারের হয়ে সর্বশেষ তিন টিটোয়েন্টিতে ৫.৪৫ ইকোনমিতে এক উইকেট শিকার করেছেন। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের মতো বাঁহাতি স্পিনার তিনি। ব্যাটিংটাও মন্দ নয়। তাই সতীর্থরা এই অলরাউন্ডারকে মজা করে ‘জুনিয়র সাকিব’ বলেই ডাকেন। ইউসুফের বয়স ২৪ বছর। উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। আশাশুনিতে বাড়ি ইউসুফের। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। স্কুল কামাই করে প্রায়ই খেলতে চলে যেতেন। এজন্য মায়ের বকুনি আর বাবার পিটুনিও কম খাননি। কিন্তু বিকেলে পাড়ার মাঠে খেলা শুরু হলে ইউসুফকে আটকায় সাধ্য কার? ভালো ব্যাটিং করতেন। সঙ্গে উইকেটকিপিংও। স্বপ্ন দেখতেন একদিন বড় ক্রিকেটার হবেন।

খেলার প্রতি তুমুল আগ্রহ ছিল ইউসুফের। আরো ভালো করার জন্য চেয়েছিলেন জেলা শহরে গিয়ে কোচিং করতে। বাড়ি থেকে জেলা সদর কয়েক কিলোমিটার দূরে। টানাটানির সংসার। অনেক কষ্ট করে সাতক্ষীরা জেলা স্টেডিয়ামে গিয়ে অন্যান্যের খেলা দেখতেন। সেখানে যাকে কাছে পেতেন, বলতেন ‘খেলতে চাই’। ইউসুফের পোশাক-আশাক দেখে তারা বলত, ‘ক্রিকেট অনেক টাকার ব্যাপার। তুই পারবি না।’ আরেক দিন একজন বললেন, ‘তুই ৫০০ টাকা নিয়ে আয়। তারপর দেখা যাবে।’ এক দুপুরে ৫০০ টাকা নিয়ে মাঠে হাজির হলেন ইউসুফ, কিন্তু যিনি টাকা আনার কথা বলেছিলেন, তাঁকে পেলেন না। বল হাতে একজনকে দেখে বললেন, ‘ভাই, আমি কি খেলতে পারব?’ তিনি সাতক্ষীরার ক্রিকেট কোচ মোহাম্মদ লালু। বললেন, ‘এখানে ভর্তি হয়ে যাও।’ কিন্তু বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন এত দূরে যাওয়া কঠিন। তা ছাড়া খরচেরও ব্যাপার আছে। যা হোক, সপ্তাহ দুয়েক পরে নেটে ব্যাট করার সুযোগ পেলেন। ইউসুফের ব্যাটিং স্টাইল ও টেকনিক মনে ধরল মোহাম্মদ লালুর।

বললেন, ‘একদিন তুই বড় প্লেয়ার হবি।’ ২০১৪ সালে সাতক্ষীরায় বিভাগীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছিল। দ্বিতীয় ম্যাচে সুযোগ পেলেন। অভিষেকেই বাজিমাত। হাফ সেঞ্চুরি করে দলকে জেতালেন সেবার। টুর্নামেন্টজুড়েই হাসল ইউসুফের ব্যাট। ফলাফল, সুযোগ পেলেন সাতক্ষীরা ক্রিকেট লীগে। ওই বছরই সাতক্ষীরা ক্রিকেট একাডেমির সেকেন্ড ডিভিশন দলের ক্যাপ্টেন হলেন। প্রথম ম্যাচে ৩৮ রান করেছিলেন। ফার্স্ট ডিভিশন খেলেছেন দক্ষিণ পারলিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংও করতেন। ইউসুফের খেলা দেখে শাহ বিলাল একাডেমির এক শিক্ষক তাঁকে খুলনা মোহামেডানে ভর্তি করিয়ে দেন। পরে ঢাকায় প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে সুযোগ পেলেন ২০১৫ সালে।

কিন্তু কপাল মন্দ। অন্য এক খেলেয়াড়ের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ায় না খেলেই বাড়ি ফিরে আসতে হলো। এরপর আবার সুযোগ পেলেন খুলনা তিতুমীর ক্রিকেট একাডেমির হয়ে। কিন্তু বাড়ির লোকজন বলত, ‘আমাদের টাকা-পয়সা নেই, খেলা তোর হবে না। তুই বিদেশে যা।’ ২০১৭ সালের শেষের দিকে শ্রমিক ভিসায় কাতার গেলেন। দোহায় যেখানে থাকতেন, এর পাশেই কাতার ন্যাশনাল স্টেডিয়াম। একদিন রাতে সেখানে খেলা দেখছিলেন। একজন ইউসুফকে ইংরেজিতে বলল, ‘তুমি খেলবে?’ সেদিন ৩৫ রান করেছিলেন। পরে ফয়সাল নামে পাকিস্তানি ওই ক্রিকেটারকে বললেন, ‘ভাই, আমাকে একটু সুযোগ দেন।’ ফয়সাল বললেন, ‘তুমি পারবে?’ ইউসুফ পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন, ‘ফিফটি করতে পারলে নেবেন?’ ওই দিন প্র্যাকটিস ম্যাচে ৩০ বলে ৬০ রান করলেন। সঙ্গে চার ওভার বল করে তিন উইকেট। এরপর সুযোগ মেলে সি ডিভিশনে। পরে ডি ডিভিশনেও খেলেছেন।

একদিন কাতার ন্যাশনাল টিমের খেলা দেখতে গিয়েছিলেন স্টেডিয়ামে। ওই দিন কাতার জাতীয় দলের খেলোয়াড় মোহাম্মদ রিজলান আর ইকবাল হুসেন নেটে প্র্যাকটিস করছিলেন। ফয়সালও ছিলেন। ফয়সালের মাধ্যমে ইউসুফ রিজলানকে বললেন, ‘আমি কি আপনাদের সঙ্গে খেলতে পারি?’ ইউসুফের বোলিং পছন্দ হয়েছিল রিজলানের। দিনকয় পরে রিজলান ফোনে তাঁকে ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার অফার দিলেন। প্রিমিয়ার লীগে গালফার আল মিসনাদ টিমের হয়ে টানা সাত ম্যাচ খেলেছেন। ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার পুরস্কার হিসেবে সুযোগ পেলেন কাতার টি-টেন লীগে। সেমিফাইনালে ব্যাটে ৯০ রানের সঙ্গে দুই ওভারে পাঁচ রানে দুই উইকেট। ফলাফল ম্যান অব দ্য ম্যাচ।

টি-টোয়েন্টিতেও লীগে ভালো খেলেছেন গালফার আল মিসনাদের হয়ে। এর পরের গল্প তো বর্ণিত হয়েছে লেখার শুরুতেই। ইউসুফ বললেন, ‘হাড়ভাঙা খাটুনির পর অনেকবার ভেবেছিলাম খেলা ছেড়ে দেব। মা-বাবা সব সময় সাহস জুগিয়ে বলেছেন, তুই পারবি। তাঁদের জন্য আজ আমি এইখানে।’ কাতারে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় ইউসুফকে। শুরুতে রোলার চালাতেন। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর কাজের চাপ কমেছে। এখন নিরাপত্তা সহকারী হিসেবে কাজ করেন ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কন্ট্রাকটিং কম্পানিতে। জাতীয় দলের খেলা থাকলে ক্রিকেট বোর্ড থেকে ইউসুফকে চেয়ে কম্পানির কাছে চিঠি পাঠানো হয়। সহকর্মীরাও সহযোগিতা করেন তাঁকে। বললেন, ‘ভবিষ্যতে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলতে চাই।’