নিজস্ব প্রতিবেদক:
সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নির্মাণসামগ্রী রড ও সিমেন্টের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। আর দাম বাড়ার জন্য ডলার, জাহাজ ভাড়া, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম, পরিবহন ও উৎপাদন খরচকে অজুহাত দেখানো হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ। বেড়ে যাচ্ছে প্রকল্প খরচ। আর আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। দেড় মাসের ব্যবধানে প্রতি টন রডের দাম ৫ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা এবং প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ৫০ টাকারও বেশি বেড়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী গত এক মাসে রডের দাম প্রায় ৫ শতাংশ দাম বেড়েছে। তবে এক বছরের হিসাবে দাম বাড়ার হার আরো বেশি। এক বছরে দাম বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। রডের পাশাপাশি খুচরা পর্যায়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিমেন্টের দামও বস্তাপ্রতি দাম ৫০ টাকার মতো বেড়েছে। মাস দেড়েক আগে খুচরা পর্যায়ে বিএসআরএম ব্র্যান্ডের প্রতি টন (৭৫ গ্রেড) রডের দাম ছিল ৮৫ থেকে ৮৬ হাজার টাকা। কয়েক ধাপে ৭ হাজার টাকা বেড়ে তা ৯১ থেকে ৯২ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে কয়েকদিন আগে সামান্য কমে এখন ৯০ থেকে ৯১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেড় থেকে দুই মাস আগে কেএসআরএম ও বায়েজিদ স্টিল ব্র্যান্ডের রড ৮০ থেকে ৮২ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৮৯ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে রানী ও বন্দর স্টিল ব্র্যান্ডের রড টনে ৪ থেকে ৫ হাজার বেড়ে ৮৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া তুলনামূলক নিম্নমানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রডও প্রতি টন ৮২ থেকে ৮৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া বাজারে প্রতি বস্তা শাহ সিমেন্টে ৫৫০ থেকে ৫৭০ টাকা, মেট্রোসেম ও আকিজ ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকা, স্ক্যান ৫৭০ থেকে ৫৮০ টাকা, ফ্রেশ ৫৩০ থেকে ৫৪০ টাকা এবং সুপারক্রিট সিমেন্ট ৫৫০ থেকে ৫৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মাস দেড়েক আগে ওসব সিমেন্ট ৪৯০ থেকে ৫৩০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারের চেয়ে দেশের বাজারে রড-সিমেন্টের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে বলে সম্প্রতি এক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদন তথ্যানুযায়ী এক মাসে বিশ্ববাজারে রডের দাম ১ শতাংশেরও কম বাড়লেও দেশের বাজারে বেড়েছে ৩ শতাংশ। আর সিমেন্টের দাম ২ শতাংশের সামান্য বেশি বাড়লেও বাংলাদেশের বাজারে তা বেড়েছে ১৩ শতাংশ। সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বছরে ৮০ লাখ টন রড ও ৩৩৬ লাখ টন সিমেন্টের চাহিদা রয়েছে। ওসবের সিংহভাগই দেশে উৎপাদন হয়। তবে বিশেষ ধরনের অল্প কিছু রড ও সিমেন্ট আমদানি হয়। বর্তমানে বাজারে ৩ ধরনের এমএস রড পাওয়া যায়। সবচেয়ে ভালো মানের হলো অটো কারখানাগুলোতে তৈরি ৭৫ গ্রেডের রড। ওই রডই বেশি বেচাকেনা হয়। তাছাড়া রয়েছে সেমি-অটো কারখানাগুলোতে তৈরি ৬০ গ্রেড এবং সাধারণ বা ৪০ গ্রেডের রড।
এদিকে রড-সিমেন্ট উৎপাদনকারীদের মতে, বিদ্যমান বিশ্বপরিস্থিতি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে দেশে রডের দাম কিছুটা বেড়েছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে অন্য পণ্যের সঙ্গে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দামও বেড়েছে। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে গেছে। দুই মাস আগে প্রতি টন স্ক্র্যাপ ৭৫০ ডলারে বুকিং দেয়া হয়েছিল। তখন ডলারের দর ছিল ৮৫ থেকে ৮৬ টাকা। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রতি ডলারে ২০ টাকার বেশি অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে। আমদানি ও উৎপাদন সব মিলিয়ে প্রতি টন রডের খরচ ১ লাখ টাকার কাছাকাছি পড়ে যায়। ওই হিসাবে ব্যবসায়ীরা লাভে নয় বরং লোকসান দিয়ে রড বিক্রি করছে। তবে আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে রডের বাজার নিম্নমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সিমেন্ট তৈরিতে ক্লিংকার, জিপসাম, স্ল্যাগ, চুনাপাথর ও ফ্লাই অ্যাশ কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ায় দেশেও তার প্রভাব পড়েছে। কাঁচামাল, ডলারের দাম, জাহাজ ভাড়া, উৎপাদন খরচ সবই বাড়ায় সিমেন্টের দামও বেড়েছে।
অন্যদিকে রড-সিমেন্টের দাম বাড়ায় আবাসন খাতের প্রসার সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রথম সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ জানান, অযৌক্তিক কিছু কারণ দেখিয়ে প্রতি বছর ঘরবাড়ি তৈরির মৌসুম এলেই রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়। ওই কারণে ডেভেলপাররা দুই বছরের প্রকল্প পাঁচ বছরেও শেষ করতে পারেন না। পাশাপাশি স্কুল-কলেজসহ সরকারের সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজও থমকে যায়। বেড়ে যায় প্রকল্পের খরচ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারের আমদানি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারদর যাচাই করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দর বাড়ার কারণও তদারকি করা জরুরি। দীর্ঘদিন ধরেই নির্মাণসামগ্রীর বাজারে বড় ধরনের সিন্ডিকেট কারসাজি করে আসছে। সরকার হস্তক্ষেপ না করলে তাদের দৌরাত্ম্য থাকবেই।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি