অনলাইন ডেস্ক :
সিরিয়া ও তুরস্কের সীমান্ত প্রাচীর মাত্র কয়েক মিটার দূরেই অবস্থিত, হাত বাড়ালেই যেন স্পর্শ করা যাবে তুরস্কের তাবু। এত কাছে হওয়ার পরেও দুই দেশের উদ্ধার তৎপরতায় রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সিরিয়ানদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক অবহেলার প্রতিফলন যেন স্পষ্ট। গত সোমবার হওয়া ভূমিকম্পের জেরে দুদর্শায় পড়েছেন উভয় দেশের লাখ লাখ মানুষ। দেশ দুটিতে হাজার হাজার ভবন ভেঙে পড়েছে। দেখা দিয়েছে খাবারসহ জরুরি নানা পণ্যের সংকট। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে আট লাখের বেশি মানুষ পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবারের সংকটে রয়েছেন। তুরস্কে ক্রেন, প্যারামেডিকস এবং স্নিপার কুকুরসহ হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী রাস্তায় জ্যাম করেছে এবং এখনও বেঁচে থাকাদের খুঁজে বের করার জন্য কাজ করছে। অপরদিকে সিরিয়া অংশে এর কিছুই চলছে না। ভূমিকম্প দেশের সীমানা মেনে ক্ষতি করে না। তবে উদ্ধার কাজে কেন দুই দেশের মধ্যে এত তফাৎ? আন্তর্জাতিক ত্রাণ প্রচেষ্টা যেন সীমানার ওপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হচ্ছে। বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এক সাংবাদিক বলেছেন, তিনি সবেমাত্র তুরস্কের আন্তাক্যা শহরে চার দিন থেকে সীমান্ত অতিক্রম করেছেন। যেখানে চারদিকে শুধু উদ্ধার তৎপরতার শব্দ। অপরদিকে সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের বাসনিয়া গ্রামের জলপাই গাছের মধ্যে বেশিরভাগই নীরবতা। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স ফোর্স যা হোয়াইট হেলমেট নামে পরিচিত এবং যারা বিরোধী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কাজ করে, তারা সামান্য কিছু সরঞ্জাম দিয়েই যা করতে পারে তা করেছে। অঞ্চলটিতে আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সিরিয়ার নাগরিক ‘আবু আলা’ জানান, ভূমিকম্প তার বাড়ি গ্রাস করেছে এবং তার দুই সন্তানের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আবু আলা তার নিখোঁজ ১৩ বছর বয়সী ছেলের সন্ধানের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ক্ষতিগ্রস্ত এক সিরিয়ান বলেন, এখানে কোনো তাঁবু নেই, কোন সাহায্য নেই, কিছুই নেই। আমরা এখন পর্যন্ত ¯্রষ্টার রহমত ছাড়া আর কিছুই পাইনি। হোয়াইট হেলমেটের এক সদস্য ইসমাইল আল আবদুল্লাহ বলেন, তারা বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের সন্ধান করছেন, কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তিনি সিরিয়ার জনগণের প্রতি বিশ্বের অবহেলাকে তুলে ধরে বলেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে রক্ত লেগে আছে। ইসমাইল বলেন, আমরা ১২০ ঘণ্টারও বেশি সময় পার হওয়ার পরে বেঁচে থাকা লোকদের সন্ধান করা বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা আমাদের জনগণকে বাঁচানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা পারিনি। কেউ আমাদের কথা শোনেনি। আমরা প্রথম থেকেই জরুরী পদক্ষেপের জন্য, জরুরী সাহায্যের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। কেউ সাড়া দেয়নি। তারা শুধু বলছে, আমরা আপনাদের সাথে আছি, আর কিছুই না। আমরা বলেছিলাম, আমাদের সরঞ্জাম দরকার কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। ইসমাইল জানায়, সিরিয়ার এই অংশে যে আন্তর্জাতিক সাহায্য পৌঁছায় তা খুবই সামান্য। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের অনেককে বাব আল-হাওয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যা সিরিয়া-আমেরিকান মেডিকেল সোসাইটি দ্বারা পরিচালিত। হাসপাতালের চিকিৎসা জেনারেল সার্জন ডা. ফারুক আল ওমর আমাকে বলেন, শুধুমাত্র একটি আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে তারা ৩৫০ জন রোগীর চিকিৎসা করেছে। ‘আমি যখন তাকে আন্তর্জাতিক সাহায্যের বিষয়ে জিজ্ঞেস করি, তখন সে মাথা নেড়ে বলে আমরা এই বিষয়ে বেশি কথা বলতে পারব না। আমরা এটি নিয়ে অনেক কথা বলেছি এবং কিছুই হয়নি। এমনকি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও আমাদের পর্যাপ্ত কর্মী নেই। তাহলে ভূমিকম্পের পরে এই বিপর্যয়ের মধ্যে অবস্থা কেমন হতে পারে কল্পনা করুন।’ হাসপাতালের করিডোরের শেষে দেখা যায় একটি ছোট বাচ্চা একটি ইনকিউবেটরে শুয়ে আছে। নাম, মোহাম্মদ গাইয়্যাথ রজব। মাথার খুলি থেঁতলে গেছে এবং তার শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তাররা নিশ্চিত হতে পারছেন না, তবে তারা মনে করছেন তার বয়স প্রায় তিন মাস। তার বাবা-মা দুজনেই ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল এবং একজন প্রতিবেশী তাকে তার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অন্ধকারে একা কাঁদতে দেখে এখানে নিয়ে আসে। ভূমিকম্পে খালা এবং চাচাতো ভাইকে হারিয়েছে ফাদেল ঘাদব, তিনি বলেন, এটা কিভাবে সম্ভব যে জাতিসংঘ মাত্র ১৪ ট্রাক সাহায্য পাঠিয়েছে? আমরা এখানে কিছুই পাইনি এবং মানুষ রাস্তায় দিন কাটাচ্ছে। সিরিয়ার হেরেমে আন্তর্জাতিক উদ্ধারকারী দলের অনুপস্থিতিতে শিশুরা ধ্বংসস্তুপ অপসারণ করছে। এবারই প্রথম নয়, এর আগেও সিরিয়ার জনগণকে অবহেলা করা হয়েছে এবং তারা অবহেলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারপরও আরও সাহায্য আসছে না বলে ক্ষোভ রয়েছে জনগণের মধ্যে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা, কখন ভাঙবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই নিরবতা।
আরও পড়ুন
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২
তীব্রতর হচ্ছে ইসরায়েলি হামলায় লেবাননে যুদ্ধ
হারিকেন হেলেনে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৯০ জনের মৃত্যু