গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জের নদ-নদীগুলোর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এই দুই জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে নদীর তীর উপচে নতুন করে সিলেট নগরীরর বিভিন্ন এলাকার বাড়িঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বন্যাকবলিত পরিবারগুলো দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগের আশঙ্কা করছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত জেলার প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বেড়েছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৯৯ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩ সেন্টিমিটার এবং সারি নদের সারিঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর বাইরে জেলার ছোট ছোট অন্যান্য নদ-নদীর পানিও ক্রমশ বাড়ছে।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পানি ক্রমশ বাড়ছে।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেট নগরের ৮ থেকে ১০টি এলাকা ছাড়াও জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও সদর উপজেলার অন্তত ৫০০ গ্রাম এরই মধ্যে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে।
একমাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ফের বন্যাকবলিত হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বানভাসিরা। নগর ও পাঁচটি উপজেলায় অন্তত চার থেকে সাড়ে চার লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, সিলেট নগরের তালতলা, জামতলা, সোবহানীঘাট, তেরোরতন, উপশহর, কালীঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় পাশের সুরমা নদীর পানি উপচে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষজন ভোগান্তি নিয়ে পথ চলছেন। অনেক বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি উঠেছে। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে হাঁটুপানি। ঘরের ভেতরে পানি ওঠায় অনেকে নিরাপদে সরে যাচ্ছেন। সিলেটের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কালীঘাটের বিভিন্ন দোকান তলিয়ে যাওয়ায় সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত জানান, স্থানীয় প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির দিকে সার্বিক নজরদারি রাখছেন। প্রয়োজনীয় স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এদিকে জেলার পাঁচটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বাড়ি-ঘর, মসজিদ, মন্দির, রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে পড়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ১১ জুন থেকে সিলেটে দিনে-রাতে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। আর সিলেটের উজানে ভারতের মেঘালয় ও আসামে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়াতে পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফের বন্যায় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা এবং নগর এলাকার নিম্নাঞ্চলে পানি উঠেছে। কিন্তু এখনো বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। ফলে বড় বন্যার পুনরাবৃত্তি হতে পারে, আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
এর আগে গত ১৫ মে থেকে সিলেটজুড়ে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছিলেন জেলার প্রায় চার লাখ মানুষ।
এদিকে সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারায় পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করায় অনেক স্থানে নদীর ডাইক ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এরই মধ্যে সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সড়ক পানিতে তলিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলার সদর, পূর্ব ও পশ্চিম জাফলং, পূর্ব ও পশ্চিম আলীরগাঁও, আসামপাড়া, রুস্তুমপুর, তোয়াকুল ও লেংগুড়া ইউনিয়নের ৮০ ভাগ এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে।
গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান বলেন, এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বন্যায় অসংখ্য মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যা কবলিত এলাকায় ৪২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পানিবন্দি মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হচ্ছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ রনিখাই এবং পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের ৭৫ শতাংশ এলাকায় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া কানাইঘাটে সুরমার পানি পৌরশহরেও পানি ঢুকেছে। যত সময় যাচ্ছে, ততই পানি বাড়ছে। এছাড়া উপজেলার পূর্ব ও পশ্চিম লক্ষ্মীপ্রসাদ, সাতবাঁক, চতুল ও সদর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর, জালালাবাদ, টুকেরবাজার ইউনিয়নসহ নদী তীরবর্তী ও নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, আগামী ২৩ জুন পর্যন্ত সিলেটে ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বন্যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
আবহাওয়া সিলেট অফিস সূত্র আরও জানায়, আগামী ১০ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সিলেটে ভারী বর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে ১৭ থেকে ১৯ জুন ভারী বর্ষণ হতে পারে।
সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যায় লক্ষাধিক মানুষ বিপাকে
এদিকে সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় ১৮৫ মিলিমিটার বৃস্টিপাত রেকর্ড করেছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, বৌলাই নদীসহ অন্যান্য নদনদীর পানি বাড়ছে। সুরমা নদীর ছাতক পয়েন্টে ২১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করায় পানিবন্দি হয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।
সুনামগঞ্জ শহরের নবীননগর, ওয়েজখালী, হাছননগর, সুলতানপুরে পানি প্রবেশ করেছে। জেলার তাহিরপুর, দোয়ারা, বিশ্বম্বরপুর, জামালগঞ্জ ও ছাতক উপজেলার সঙ্গে অন্যান্য অংশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
এদিকে ছাতক, দোয়ারা ও সদরে বন্যায় তলিয়ে গেছে বহু পাকা রাস্তাঘাট, প্লাবিত হয়েছে হাজারও ঘরবাড়ি, দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শতাধিক মৎস্য খামার। প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এখানে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
ছাতক, দোয়ারা ও সদর উপজেলায় ২০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, জেলার ৪টি পৌরসভা ও ১২ টি উপজেলায় ২৪৫ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
—-ইউএনবি
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি