জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার :
করোনার সংকটের দুই বছর থেকে কুলাউড়ার চাতলাপুর চেকপোস্ট দিয়ে বৈধভাবে যাত্রী পারাপার বন্ধ থাকার কারণে কুলাউড়ার আলীনগর-মুড়াইছড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ বাড়ছে। পাহাড়ী বিস্তীর্ণ এই সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদকসহ চোরাচালানের দীর্ঘদিনের অভিযোগ থাকলেও নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে।
গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৩৯জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। তবে আটক রোহিঙ্গারা আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে দালালের মাধ্যমে শিকড়িয়া সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের কথা জানালেও বিষয়টি অস্বীকার করেছে বিজিবি। গত এক বছরে পৃথিমপাশার শিকড়িয়া সীমান্ত দিয়ে ৩৯ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। তাদের মৌলভীবাজার শহরের ঢাকা বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ।পরবর্তীতে তাদের কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এদিকে রোহিঙ্গা প্রবেশের ঘটনায় কুলাউড়ার সীমান্ত এলাকায় টহল জোরদার বাড়িয়েছে বিজিবি।
সরেজমিন কর্মধা ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী কয়েকটি এলাকায় ঘুরে জানা যায়, এই দুই সীমান্তের ১৮৪২-১৮৫১ নং আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার দিয়ে দীর্ঘদিন থেকে ফেনসিডিল, ইয়াবা, নাসির বিড়ি, গাঁজা, অফিসার চয়েজ, ডিসের ছাতা, সিএনজি গাড়ির টায়ার-টিউবসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী আসছে। এর সাথে নতুন করে সীমান্তবর্তী আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের নিকটআত্মীয়রা উভয় দেশে অবৈধভাবে দালালদের মাধ্যমে যাওয়া আসার অভিযোগ থাকলেও বর্তমানে সেটির সাথে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। এই কাজের সাথে সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন চোরাকারবারীরা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। অর্থের বিনিময়ে বিজিবির তালিকাভুক্ত ও এলাকার চিহ্নিত চোরাকারবারিরা এসব কাজে সক্রিয় রয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশেষ করে শিকড়িয়া সীমান্তের ১৮৪৬ নং সীমানা পিলারের ভারতের পাহাড়ি সেগুন টিলা এলাকা দিয়ে চোরাচালান ও পাচারকারীরা বেশ সক্রিয় রয়েছে। পাচারকারীরা মাদক ও অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের স্থানীয় রবিরবাজার-টিলাগাও-তারাপাশা দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রেরণ করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কুলাউড়ার কর্মধা ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী আলীনগর ও মুড়াইছড়া ক্যাম্পের আওতাধীন ১৮৪২ থেকে ১৮৫১ নং সীমান্ত পিলার এলাকা দিয়ে চিহ্নিত চোরাকারবারীরা মাদকসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী এবং মানুষ অনুপ্রবেশের সাথে বিজিবির তালিকাভুক্ত প্রায় ২০-২৫ জন চোরাকারবারী ও দালাল জড়িত রয়েছেন। তারা কৌশলে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা এবং ভোর ৫টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের দায়িত্ব পালাবদলের (শিফটিং ডিউটি) সময়ে কাঁটা তারের উপর দিয়ে কাঠ দিয়ে উভয় পাশে মই লাগিয়ে মানুষ পারাপার ও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করায়। একই পদ্ধতিতে তারা গরুসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য আনে। এজন্য তারা স্থানীয় আশপাশের মানুষের কাছ থেকে দুই থেকে তিন হাজার টাকা উৎকোচ নিলেও রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে পনেরো থেকে ষোল হাজার টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই চক্রের সাথে পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সত্তারের ছেলে কালাম মিয়া (৩৩), সিদ্দেক আলীর ছেলে আরজদ (৩০), গৌছ আলীর ছেলে মাছুম (২৬), আমুলী গ্রামের সুমন আহমদ (৩৪), জসিম, আশিক, আলীনগর গ্রামের আক্তার, জায়েদ, ধলিয়া গ্রামের আহাদ আলী, শামীম, জুনেদ, তাজুল, দশটেকি গ্রামের জসিমসহ আরো অনেকে জড়িত রয়েছেন বলে একাধিকসূত্র নিশ্চিত করেছে। এরমধ্যে কালাম, সুমন, জসিম বিজিবির তালিকাভুক্ত চিহ্নিত চোরাকারবারী। এই ঘটনার সাথে এরা সম্পৃক্ত রয়েছে বলে জানা গেছে। চোরাকারবারীদের তালিকায় পৃথিমপাশা ইউনিয়নের আব্দুল খালিক, শওকত আলী, ফজলু মিয়া, শাহিন মিয়া, সুন্দর আলী, আছকির আলী, আসিদ আলী, সামদ আলীসহ অনেকেই সম্পৃক্ত রয়েছে বলে লোকেমুখে গুঞ্জন রয়েছে।
কাঁটাতারের বেড়া পারাপারের সময় নারী ও তরুণীরা দালাল এবং পাচারকারী দ্বারা কৌশলে যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও কেউ লোক লজ্জার ভয়ে মুখ খুলেনি। বিষয়টি পাচারের সময় প্রথমে পুরুষকে কাঁটাতারের ওপারে প্রবেশ করালেও সুন্দরী তরুণীদের পার না করিয়ে কাঁটাতারের উপর থেকে বিএসএফ চলে আসছে বলে মই সরিয়ে নেয়। এসময় তরুণীদের ও নারীদেরকে পরে পাঠানো হবে বলে জিম্মি করে নির্জনস্থানে নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতন করে। এমন তথ্যটি পরবর্তীতে কোন নারী ও তরুণীরা তাদের পরিবার এবং আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রকাশ না করলেও চোরাকারবারী সদস্যদের অনেকেই স্থানীয় এলাকার যুবকদের কাছে আলোচনা করার গুঞ্জন রয়েছে।
এক বছরের ভিতরে দুই দফায় ৩৯ জন রোহিঙ্গারা আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে স্বীকার করেছে তারা টাকার বিনিময়ে দালালের মাধ্যমে ভারত থেকে কুলাউড়ার শিকড়িয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য।
এদিকে সীমান্ত এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান প্রতিরোধে ৪৬ বিজিবি (শ্রীমঙ্গল) এর অধিনায়ক মো: মিজানুর রহমান শিকদার ১৩মে কুলাউড়ার আলীনগর ও মুড়াইছড়া ক্যাম্প এলাকার জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ ও তথ্য দাতাদের নিয়ে পৃথক পৃথক জরুরী সভা করেছেন। এসময় তিনি বিজিবির স্থানীয় ক্যাম্পের সদস্যরা ঠিকমত দায়িত্ব পালন করছেন কিনা এবং রোহিঙ্গা ও চোরাচালানের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে সহযোগিতা চান।
১২ মে সকাল ১১টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মৌলভীবাজার শহরের বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে শিশুসহ ১৮ জন রোহিঙ্গা সদস্যকে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)-এর সহযোগিতায় আটক করে মৌলভীবাজার সদর মডেল থানা পুলিশ। আটককৃতদের মধ্যে নারী ও পুরুষ রয়েছে। তবে এদের অধিকাংশই রয়েছেন শিশু।
আটককৃতরা হলো, সইদুল আমিন (১৯), আয়েশা খাতুন (২৭), তারেক জমিন (১২), আয়াতুল্লাহ (৬), আসমা বেগম (৮), ইনসা বেগম (২), ফাতেমা (৬ মাস), ইয়াসিন আরাফাত (২৬), নুর সাবা (২২), সমির (৫), সমিরা (১২), মনসুর আহমদ (৩০), বিবি আয়েশা (২৫), ইয়াসর (৪), কয়সর (২), কুলসুমা (১২), ইসপা (৯) ও আমিনা বেগম (২০)।
এছাড়া এর আগে ২০২১ সালের ১৭ জুলাই জেলা সদরের ঢাকা বাসস্ট্যান্ড থেকে আরো ২১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছিল মৌলভীবাজার মডেল থানা পুলিশ। আটকদের মধ্যে চারটি মেয়ে শিশু, তিনটি ছেলে শিশু, আটজন নারী ও ছয়জন পুরুষ ছিলেন।
আটককৃতরা হলেন, মো: শাকের (২৭), লায়লা বেগম (২৭), নূর হালিমা (৭), নূর কলিমা (৬), নূর সামিরা (৪), মো. ছোফায়েদ (২), নাজমূল্লাহ (২২), সানোয়ারা (২০), নাসিমা (৩), ইউছুফ আলী (২৮), মোস্তাকিমা (২১), ইসলামা খাতুন (৪৯), মিনার নাহার (১৭), মোহাম্মদ ইউনুছ (৫), রোকেয়া বেগম (১৫), জুবায়ের (২১), মনোয়ারা (২১), মো. ওমায়ের (নয় মাস), মোহাম্মদ ইয়াহিয়া (২৫), মো: কামাল (২০) ও সেনুয়ারা আক্তার (১৮)।
চোরাকারবারী দলের অন্যতম সদস্য সুমন আহমদ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, আমার জীবনে আমি কোনদিনও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে জড়িত নই। তবে মাঝেমধ্যে টুকটাক নাসির বিড়ি আনি। রোহিঙ্গা পাচারের সাথে পশ্চিম গণকিয়া এলাকার শারমিন তার ভাই মনাই ও গণকিয়া গ্রামের তোফেল জড়িত। ১৮৪৬ নং সীমানা পিলারের সেগুন টিলার পূর্ব পাশ দিয়ে সকাল ও সন্ধ্যায় রোহিঙ্গা প্রবেশ করে।
চোরাকারবারী দলের আরেক সদস্য কালাম মিয়া জানান, আমি এসব কারবার ছেড়ে দিয়েছি একবছর হলো। আমি এখন গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। অনেকে আমার বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা অভিযোগ তুলে ফাঁসাতে চাচ্ছে। ১৫-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে এলাকার শারমিন, তোফেল, আনসার, আরজদের মাধ্যমে।
রোহিঙ্গা পাচারের সাথে জড়িত শারমিনের ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আটক রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে ভারতে প্রবেশ করে। পরে তারা ভারতের জম্বু-কাশ্মীর থেকে ত্রিপুরা হয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য উভয় দেশের দালালের মাধ্যমে কুলাউড়ার পৃথিমপাশার শিকড়িয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ভারতের দালাল রোহিঙ্গাদের জানায় বাংলাদেশে তাদের লোক আছে। বাংলাদেশের দালাল তাদের কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছে দেবে। সেভাবে বাংলাদেশের দালালরা তাদের সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করিয়ে মৌলভীবাজারের ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেয়। এরপর পুলিশ তাদের সেখান থেকে আটক করে।
মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, যেভাবেই হোক রোহিঙ্গারা সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশ করে মৌলভীবাজারে এসেছে। সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি’র পাশাপাশি পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আটক রোহিঙ্গাদের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে।
বিজিবি-৪৬ ব্যাটালিয়নের (শ্রীমঙ্গল) কার্যালয়ের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মিজানুর রহমান শিকদার গণমাধ্যমকে জানান, পৃথিমপাশার শিকড়িয়া সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে কিনা সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। বিষয়টি বিজিবি ও স্থানীয় এলাকার মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়নি। তারপরও আমরা সীমান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় মানুষদের সাথে সভা করে বিজিবির পাশাপাশি স্থানীয়দের চোরাচালান ও অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে সতর্ক থাকতে বলেছি। রোহিঙ্গা ইস্যুৎ নিয়ে সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা জোরদার বাড়ানো হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সীমান্ত এলাকায় আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ১১৫ কিলোমিটারের ভেতরে যেভাবে নিয়ম সেভাবে টহল দেয়া হচ্ছে। সন্দেহমূলক যেসব স্থান রয়েছে সেখানে টহল বাড়ানো হয়েছে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি